—ফাইল চিত্র।
বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই রাজ্যকে কয়েকটি জরুরি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাইয়া দিল। রাজনীতি এই রাজ্যে, এই দেশে, কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে? ছাত্রছাত্রীরা যদি অন্যায় করিয়া থাকেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা রাজ্যপাল তাঁহাদের কোন রাজনীতি শিখাইলেন? গণতান্ত্রিক সৌজন্য বলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিরুদ্ধ দলের রাজনৈতিক নেতা আসিলে ছাত্রছাত্রীরা তাঁহাকে প্রবেশ করিতে বাধা দিতে পারেন না, তাঁহাকে নিগ্রহ করিতে পারেন না। বাস্তবিক, বিশ্ববিদ্যালয় যে মুক্ত বিদ্যা-বুদ্ধি-চর্চা-চর্যার স্থল, তাহা ছাত্রছাত্রীরাই অন্যান্য পরিস্থিতিতে মনে করাইয়া দেন। সুতরাং বিজেপি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে তাঁহারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে ঢুকিতে দিবেন না বলিয়া যে ভাবে তাঁহারা বিক্ষোভে শামিল হইলেন এবং শারীরিক ভাবে তাঁহাকে বাধাদান করিলেন, তাহা অত্যন্ত আপত্তিকর। অবশ্যই, মন্ত্রীর উপর ছেলেমেয়েরা অকারণে চড়াও হন নাই, বিপরীত পক্ষেও নানা উস্কানি ছিল। কিন্তু উস্কানির মুখে বিপথে চালিত না হওয়া, সংযমের সহিত বিরোধিতায় স্থিত থাকিবার শিক্ষাও তো একটি জরুরি শিক্ষা। তাহা হইতে ভ্রষ্ট হওয়ার মূল্য যে কেবল নৈতিক নহে, রাজনৈতিক ভাবেও চুকাইতে হয়, তাহাও জানিবার কথা। মাঝখান হইতে, প্রধানত বাম মতাদর্শচালিত ছাত্রছাত্রীরা বিজেপি নেতাকে যে ভাবে আক্রমণ করিলেন, তাহাতে শুধু দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা নহেন, গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাসী নাগরিকরাও ছাত্রছাত্রীদের সমালোচনায় মুখর হইলেন। রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ইহা আত্মপরাভবী। চুল ছিঁড়িয়া জামা টানিয়া গালাগাল বর্ষণ গুন্ডাসমাজের কাজ, ছাত্রসমাজের নহে।
ছাত্রছাত্রীরা ঝানু রাজনীতিক নহেন। ফলে তাঁহাদের দিক হইতে এমন স্খলন ঘটিলে তাঁহাদের তিরস্কার করা জরুরি। কিন্তু দুই বারের সাংসদ ও মন্ত্রী মহাশয়ের অশোভন ব্যবহারকে ক্ষমা করা অতি দুষ্কর। বাবুল সুপ্রিয় সে দিন যে রূপ দেখাইয়াছেন, তাহাতে স্পষ্ট, ভারতীয় রাজনীতি সত্যই অতলে ডুব দিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হইয়া আসিয়া ছাত্রদের সহিত যে অশোভনতা তিনি করিয়াছেন, এবং উপাচার্যের সহিত যে ভাষা ও ভঙ্গিতে কথা বলিয়াছেন, দেখিয়া বিস্ময়াহত না হইয়া উপায় নাই। অধ্যাপকরাও বলিয়াছেন, কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নিকট হইতে এমন ব্যবহার তাঁহাদের ভাবনার অতীত। মন্ত্রী বুঝাইয়া দিলেন, এ দেশে মন্ত্রী হইলে কুকথা বলিয়া কদাচার করিয়াও সম্মান ‘দাবি’ করা যায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভদ্রাচারী উপাচার্য অনুরোধ জানাইলেও মন্ত্রী তাঁহাকে অসম্মান করিতে পারেন। যাঁহারা অভিযোগ করিতেছেন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মান ছাত্রছাত্রীরা নষ্ট করিয়াছেন, তাঁহাদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া দরকার যে, মন্ত্রিবর কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানকে পদদলিত করিয়াছেন।
এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যে অকথ্য দৌরাত্ম্য চালাইয়াছে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানধারী বাহিনী, তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানকে হত্যা করিয়াছে। নিকৃষ্ট ধ্বংসকাণ্ডের এই নমুনার পর ছাত্রছাত্রীদের অসৌজন্যের অভিযোগ তুলিবার নৈতিক অধিকারই ওই বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকদের থাকিতে পারে না। মনে রাখিতে হইবে, ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু তাঁহাদের নিজেদের ক্যাম্পাসে রাজনীতি করিতেছিলেন— এবং দৌরাত্ম্য-বাহিনী ছিল বহিরাগত। বহিরাগতরা কোন পক্ষের, এ বার অন্তত সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নাই। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ওই ‘অনুপ্রবেশ’কারীদের কী শাস্তি প্রাপ্য, সেই প্রশ্নই থাকিয়া যায়। সে দিনে রাজ্যপালের ব্যবহারও স্মরণে রাখিবার মতো। সমস্ত সাংবিধানিক প্রথা ও রাজনৈতিক সৌজন্য পদদলিত করিয়া, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ অমান্য করিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন মন্ত্রীকে সঙ্গ দিতে। দেখাইয়া গেলেন— অন্তত এ রাজ্যের রাজনীতিতে এখন আর কোনও কিছুই ‘অকর্তব্য’ নহে। যদৃচ্ছা চলিবার নামই রাজনীতি।