ডাক্তার কাফিল খানকে মুক্তি দিবার আদেশ ঘোষণা করিয়া ইলাহাবাদ হাইকোর্ট বলিয়াছে, তাঁহার বিরুদ্ধে জাতীয় সুরক্ষা আইন প্রয়োগ এবং তাঁহাকে এত দিন কারাবন্দি রাখা বেআইনি কাজ হইয়াছে। বস্তুত, কাফিল খান সংক্রান্ত ঘটনাপরম্পরায় রাজ্য প্রশাসনের প্রতিহিংসার পরিচয় এতটাই স্পষ্ট যে, নিতান্ত নির্লজ্জ ভক্ত না হইলে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের স্বরূপ বুঝিতে কাহারও বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ তিন বছরেই দুঃশাসনের নূতন ইতিহাস রচনা করিয়াছে। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন রায় সেই হতাশার ঘন অন্ধকারে একটি আলোকবিন্দু গণ্য হইবে। গণতান্ত্রিক মানসিকতা এবং আইনানুগ সুশাসনের সার্বিক ক্ষয়ের এই দুর্ভাগা দেশে বিচারবিভাগ আজও, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে, নাগরিকের ভরসা।
হাইকোর্টের বিচারপতিরা বলিয়াছেন, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত যে বক্তৃতার জন্য কাফিলের বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করিবার অভিযোগ, সেখানে তিনি দেশবিরোধী কোনও কথা বলেন নাই, বরং দেশের সংহতি এবং ঐক্যের সপক্ষে সওয়াল করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কারাগারে রাখিবার পূর্ববর্তী বিধানটি ওই বক্তৃতার বিচ্ছিন্ন অংশের ভুল ব্যাখ্যার ফল। এই অবিচারের পিছনে বিচারব্যবস্থার নিম্নতর স্তরের ‘বিচ্যুতি’র পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ সরকারের ভূমিকাটি অতিমাত্রায় প্রকট। গোরক্ষপুর হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া কাফিল খানের বিরুদ্ধে যোগী আদিত্যনাথ কুপিত হইয়াছিলেন। শুরু হইয়াছিল তাঁহার হেনস্থা। সরকারি রক্তচক্ষুতে ভীত না হইয়া সমালোচনা চালাইয়া যাইবার পাশাপাশি এই চিকিৎসকের ধর্মীয় পরিচয় সেই রাষ্ট্রীয় আক্রমণের পিছনে একটি বড় কারণ ছিল না, এমন কথা মনে করা অত্যন্ত কঠিন। এই ঘটনাটিকে অপশাসন এবং অবিচারের বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত বলিয়া ভাবিবার কোনও উপায় নাই, ইহা একটি আপাদমস্তক ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতার পরিণাম, যে ব্যাধি এখন কেবল উত্তরপ্রদেশে নহে, কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের শরীরে ও মনে নহে, গোটা দেশের শাসনতন্ত্রে সংক্রমিত, যাহার প্রকোপ কোভিড-১৯ অপেক্ষা কোনও অংশে কম নহে।
সেই কারণেই বিচারবিভাগের নিকট দেশের গণতন্ত্রের দাবি বহু গুণ বাড়িয়া যায়। দ্রুত সুবিচারের দাবি, রাষ্ট্রীয় অপশাসনের প্রতিকারের জন্য অবিলম্বে তৎপর হইবার দাবি। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার প্রেরণাতেই প্রশ্ন তোলা যায়— কাফিল খানের প্রতি যে অন্যায় হইয়াছে, তাহার প্রতিকার কি আরও আগে করা সম্ভব ছিল না? অপরাধ না করিয়াও তাঁহাকে দীর্ঘ সাত মাস কারাগারে কাটাইতে হইল কেন? কেনই বা তাঁহার প্রবীণ জননীকে সুবিচারের সন্ধানে মাসের পর মাস অস্বাভাবিক হয়রানি ও উদ্বেগের মধ্যে থাকিতে হইল? ঠিক তেমনই, এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এমন অনেক সমাজকর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের যোদ্ধা, কবি, সাংবাদিক প্রমুখ কারাগারে অথবা গ্রেফতারির খাঁড়া মাথায় লইয়া দিনযাপন করিতেছেন, যাঁহারা সরকারি অনাচারের প্রতিবাদে মুখর হইয়াছিলেন অথবা এখনও মুখর। কোন অভিযোগ কতখানি যুক্তিযুক্ত, তাহার বিচার অবশ্যই আদালতের হাতে। কিন্তু যথাসম্ভব দ্রুত সুবিচার নিষ্পন্ন করাও সুবিচারের আবশ্যিক শর্ত নয় কি? এবং, সেই বিচারে যদি রাষ্ট্রযন্ত্রীদের প্রতিহিংসা বা অনাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাঁহাদের তীব্র তিরস্কার এবং প্রয়োজনে শাস্তিদানের অবকাশও কি গণতান্ত্রিক ভারতের শাসনতন্ত্রে নাই? ক্ষমতার স্বৈরতন্ত্রী তাণ্ডব যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে নীতিভ্রষ্ট ক্ষমতাবানদের উপর বিচারবিভাগের ন্যায়দণ্ড প্রবল বেগে ও বিক্রমে নামিয়া আসিবার প্রয়োজন সমধিক। ইলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়, এমনই আরও কিছু সাম্প্রতিক রায়ের মতোই, আজও আশা জাগায়। সুবিচারের আশা।