ছবি: সংগৃহীত
গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল নাই, দুর্বলতা ক্রমশই বাড়িতেছে। বিশ্বের একশত পঁয়ষট্টিটি দেশে সমীক্ষা করিয়া এমনই ফল মিলিল। অর্থনীতি বিষয়ক একটি প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ পত্রিকা নিয়মিত গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ করিয়া থাকে। নির্বাচনী পদ্ধতি ও বহুত্ববাদ, সরকারের কর্মরীতি, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা— এই পাঁচটি বিষয়ের নিরিখে প্রস্তুত হয় ওই সূচক। সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, মাত্র বাইশটি দেশ ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’, সেগুলিতে বাস-রত মানুষ পাঁচ শতাংশের কিছু অধিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালেই পূর্ণতার মর্যাদা হারাইয়া ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নামিয়াছিল, এই বৎসরও সে পূর্বের মর্যাদা ফিরিয়া পায় নাই। ভারত বরাবরই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, এই বৎসর নম্বর কমিয়া তাহার স্থান হইয়াছে পঞ্চাশটি দেশের পরে। নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষয় ভারতের অবনমনের প্রধান কারণ। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের জেরে নাগরিকের অধিকার খর্ব, অসমে নাগরিক পঞ্জির প্রতিরোধ ভারতে গণতন্ত্রকে ‘পিছাইয়াছে’। আশ্চর্য নহে। মোদী-শাহ রাজনীতি ও প্রশাসনের যে মুখ ও অভিমুখ নির্মাণ করিয়াছেন, তাহাতে নাগরিকের প্রত্যাশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত রাজনীতির চেহারা, সরকারি নীতি, এবং পুলিশ-প্রশাসনের কার্যরীতির সংযোগ সামান্যই। দেশ জুড়িয়া জনশক্তির বিপুল অংশ ব্যয় হইতেছে সরকারের বিরোধিতা করিতে। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের সূচকে ভারত পিছাইল কি না, সে প্রশ্ন বাঁচিয়া থাকে না। কতটা পিছাইয়াছে, তাহা জানিবার অলস কৌতূহল থাকে মাত্র।
ভারত যে সূচকে দশ ধাপ পিছাইয়াছে, তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। গণতন্ত্রের এই মন্দ দশা সারা বিশ্বেই ঘনীভূত হইতেছে, এই দেশও ব্যতিক্রম নহে। চিন এবং দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি গণতন্ত্রের নিরিখে বরাবরই পশ্চাতে, এই বৎসর আরও পিছাইয়াছে। দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশেও গণতন্ত্র দুর্বল হইয়াছে। নিঃসন্দেহে ইহার অন্যতম কারণ, সকলের মধ্যে সম্পদের সমবণ্টনে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা। গত চার দশক পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৃদ্ধি হইয়াছে, পুঁজি বাড়িয়াছে, কিন্তু কর্মীদের পারিশ্রমিক সেই তুলনায় বাড়ে নাই। অধিকাংশ সম্পদ কতিপয় ধনীর হস্তগত হইয়াছে। ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানে উন্নতি থমকাইয়া গিয়াছে। গণতন্ত্র তাহার নির্বাচনী রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বা আইন-আদালত দিয়া এই অন্যায় অসাম্য আটকাইতে পারে নাই। ফলে উদারবাদ ও গণতন্ত্রের প্রতি সন্দেহ বাড়িয়াছে।
বঞ্চনার তিক্ততা অনুভূত হইলেও, তাহার কারণ স্পষ্ট হয় নাই অধিকাংশের কাছে। নেতা-ব্যবসায়ীর সাজশে ‘সাঙাততন্ত্র’ নাগরিককে প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিতেছে, তাহা অজানা নহে। তবু ভিন্ন জাতি, অন্য দেশের মানুষের উপর বঞ্চনার দায় চাপাইবার প্রবণতা দেখা দিয়াছে। পূর্বের মর্যাদা ফিরিয়া পাইতে সামাজিক আধিপত্যের পুরাতন নকশাকে ফের আঁকড়াইয়া ধরিতেছে। ইহাতে পরিচয়-নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার, সমমর্যাদার আদর্শ প্রতিহত হইতেছে। প্রশ্ন উঠিতেছে, গণতন্ত্রের ভেক বজায় রাখিয়া কী লাভ? উত্তর খুঁজিতে চাহিতে হইবে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি বা তুরস্কের মতো দেশগুলির দিকে, যেগুলি গণতন্ত্র হইতে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকিয়াছে। তাহারা কি ভাল আছে? ইহাদের প্রশাসন কি নাগরিকের প্রতি অধিক সংবেদনশীল? জীবনের মান উন্নত? না, বরং জনস্বার্থ অধিক উপেক্ষিত। গণতন্ত্রের সমস্যা কম নাই, কিন্তু তাহার সাফল্যও কম নহে। গত চার দশকে গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে আয়ুর বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার, দারিদ্র নিরসন যে হারে ঘটিয়াছে, ইতিহাসে তাহার নজির নাই। অতএব গণতন্ত্রের জোরও কম নহে। গণতন্ত্র দুর্বল হইলে সমস্যা, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র সবল হইলে সমূহ সর্বনাশ।