প্রতীকী ছবি
যে দেশে প্রতি তিন জন মহিলার মধ্যে এক জন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন, সেই দেশে দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব অভিশাপস্বরূপ। অতিমারিজনিত লকডাউনের গোড়াতেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করিয়াছিলেন, দেশে পারিবারিক হিংসা বৃদ্ধি পাইবে। আশঙ্কাটি সত্য প্রমাণিত। জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই বৎসর মার্চ হইতে মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ অভিযোগ জমা পড়িয়াছে। সংখ্যাটি গত বৎসরের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ। পূর্বেই জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা হইতে প্রাপ্ত তথ্য জানাইয়াছিল, নির্যাতিত মহিলাদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ সরাসরি অভিযোগ জানান। সুতরাং অনুমান, নথিভুক্ত অভিযোগের বাহিরেও বিপুল সংখ্যক অভিযোগ সঞ্চিত আছে, যাহা প্রকাশ্যে আসে নাই। কেন আসে নাই? একটি কারণ হিসাবে বলা হইতেছে, ঘরে সর্ব ক্ষণ অত্যাচারী পুরুষটির উপস্থিতি। নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কিন্তু যাঁহারা সেই দুর্লভ সুযোগ পাইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই যথাস্থানে অভিযোগটি পৌঁছাইতে পারিয়াছেন কি?
বাস্তব অন্য কথা বলিতেছে। গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষেত্রে একটি হেল্পলাইন নম্বরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অনেক মেয়ের কাছেই সশরীর থানা বা মহিলা কমিশনের নিকট পৌঁছাইয়া অভিযোগ জানাইবার পথটি কষ্টকল্পনামাত্র। বিপদে পড়িলে তাঁহারা সচরাচর নিজ আত্মীয় বা পরিজনের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন উদ্ধারের জন্য। অতিমারি এবং লকডাউনের সময় এই আপৎকালীন পারিবারিক হেল্পলাইনটি অচল। সেই কারণেই একটি কার্যকর সরকারি হেল্পলাইন নম্বরের গুরুত্ব অনেক গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। নম্বর আছে, অথচ কেহ জানে না, অথবা ফোন করিলে সাড়া পাওয়া যায় না— জরুরি পরিস্থিতিতে ইহা কোনও অজুহাত হইতে পারে না। জাতীয় স্তরে নির্ভয়া কাণ্ডের পর মেয়েদের সাহায্যার্থে ১৮১ হেল্পলাইনটি চালু করিবার কথা বলা হইয়াছিল। কিছু সুপারিশও করা হইয়াছিল। কিন্তু অনেক রাজ্যই তাহার কিছু গ্রহণ করিয়াছে, অনেক কিছুই করে নাই।
পশ্চিমবঙ্গ যেমন ১৮১ নম্বরটি গ্রহণ করে নাই। কেন, সে বিষয়ে নিশ্চয় সরকারের নিজস্ব যুক্তি আছে। কিন্তু বাস্তব হইল, এই সংক্রান্ত নিজস্ব কোনও কার্যকর নম্বরও পশ্চিমবঙ্গের নাই। পরিবর্তে রাজ্য মহিলা কমিশন, উইমেন্স গ্রিভান্স সেল, কলিকাতা পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কিছু নম্বর রহিয়াছে। ফলে গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মেয়েদের রক্ষা করিবার ক্ষেত্রে একটি বিরাট ফাঁক থাকিয়া গিয়াছে। শুধুমাত্র হেল্পলাইন নম্বরই নহে, পারিবারিক হিংসার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ চালু করিবার প্রস্তাব দেওয়া হইয়াছিল, যেখানে নির্যাতিত মেয়েরা নানাবিধ সহায়তা পাইতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গে সেই কাজও বিশেষ অগ্রসর হয় নাই। সব মিলাইয়া, অতিমারি ও লকডাউনের আবহে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের পরিস্থিতি অতি করুণ হইয়াছে। এক্ষণে আরও একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। ভারতে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য যত প্রবল, তাহাতে কি রাষ্ট্রীয় পরিসরে মহিলাদের এই বিপন্নতা যথেষ্ট অনুভূত হয়? যাঁহারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেন, তাঁহারা কি মহিলাদের এই অসহায়তা সম্যক বুঝিতে পারেন? যত ক্ষণ এই সচেতনতা না আসিবে, তত ক্ষণ অবধি রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হইয়াই থাকিবে। হেল্পলাইন নম্বরের ন্যায়।