Coronavirus

সংক্রমিত বিশ্ব-রাজনীতি

এই সব কিছুর পিছনে আরও একটা ঘটনা ঘটে চলেছে নীরবে নিভৃতে, খালি চোখে এখন তাকে দেখা না গেলেও।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২০ ০০:২০
Share:

সুযোগ: করোনা-বিপর্যয় সামলানোর বৈঠকে বসেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ওয়াশিংটন ডিসি, ১০ মার্চ। এপি

কোভিড-১৯ সঙ্কট তা হলে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিল, বিশ্বায়ন আমাদের বিশ্বকে কোথায় নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুনিয়ায় এর আগে এপিডেমিক প্যানডেমিক নাইন-ইলেভন কোনও কিছুতেই এমন দেখা যায়নি যে গোটা পৃথিবীর সব লোক একই সঙ্গে একটিই কথা ভাবছে, আর কিছুই ভাবছে না, এবং সকলে একই পরিমাণ উদ্বিগ্ন উদব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর পিছনে সমাজমাধ্যম নামক বস্তুটিরও বিরাট ভূমিকা আছে নিশ্চয়। সমাজমাধ্যম-যুগ তুঙ্গে ওঠার পর মহামারির রূপটাও পুরো আলাদা হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

এই সব কিছুর পিছনে আরও একটা ঘটনা ঘটে চলেছে নীরবে নিভৃতে, খালি চোখে এখন তাকে দেখা না গেলেও। অসুখের পরাক্রম ও অসুখজনিত উদ্বেগের পারদ নেমে এলে, সঙ্কট থিতিয়ে এলে, তখন বোঝা যাবে যে ইতিমধ্যে সেখানে কতটাই পলি এনে জমিয়েছে করোনাভাইরাসের প্লাবন।

সেই প্রচ্ছন্ন নাট্যমঞ্চটি হল— দক্ষিণপন্থী অতিজাতীয়তার রাজনীতি। করোনাভাইরাসের চোটে বিশ্ব জুড়ে দেশে দেশে এখন দরজা বন্ধ করার ধুম। বাইরের সংযোগ সাময়িক ভাবে কেটে দিয়ে ভিতরটাকে বাঁচানোর স্বাভাবিক ব্যগ্রতা। সঙ্কটের সময়ে এইটুকু সকলেরই করণীয়, নয়তো সকলেরই বাঁচা দায়। মুশকিল হল, এই স্বাভাবিক ইতিবাচক কাজটা করার সময়ে অনেক দেশের নেতারাই একটা নেতিবাচক চালও চেলে রাখছেন। নিজের নিজের মতো করে রাজনৈতিক স্কোর তুলে রাখছেন, পরে কাজে লাগবে! এ-কালের বহু নেতাই তো ভেতর-বাইরের লড়াই লাগিয়ে দেওয়ার পথটাই আঁকড়ে থাকেন। বাইরের সঙ্গে ভেতরের একটা আধা-কাল্পনিক বা পুরো-কাল্পনিক সংঘাতের কাহিনির মই বেয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার আসনে ওঠেন বা স্থিত থাকেন। করোনা নামক নতুন বিশ্ব-সঙ্কটটি এই ঘরানাকে আরও শক্তপোক্ত করল বলেই মনে হয়।

Advertisement

উদাহরণ— ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথাবার্তায় ক্রমাগত একটা অভিযোগের সুর। তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন ‘তাঁর দেশ’কে এ ভাবে বিপন্ন করছে যত সব ‘বাইরে’র ভাইরাস। যে মানুষটি গত সপ্তাহের গোড়াতেও করোনাভাইরাস নিয়ে হাসাহাসি করতেন, দ্রুত ছড়ানো বিপদটাকে পাত্তা দিতেন না মোটে, গত বুধবার তিনিই আমেরিকায় ৩০ দিনের জন্য অতলান্তিক-পারাপার নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন, এবং কারণ হিসেবে নাম করেছেন ‘ফরেন ভাইরাস’-এর। সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেয়ো করোনাভাইরাস-কে আগাগোড়া ‘উহান ভাইরাস’ নামে ডাকছেন। ভাবটা যেন, চিন কেমন দেশ— বুঝ লোক যে জান সন্ধান। রিপাবলিকান সেনেটর টম কটন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছের লোক। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, যে বা যারা এই ভাইরাস দুনিয়ার উপর ছেড়ে দিয়েছে (‘হু ইনফ্লিক্টেড ইট অন দ্য ওয়ার্ল্ড’), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ঠিক সময়ে উচিত শিক্ষা দেবে, হ্যাঁ!

ও দেশের সাধারণ মানুষ এই কথার উপর নিশ্চয় ভরসাও রাখছেন। এমনিতেই আমরা দেখি, নিজেকে ‘সর্বশক্তিমান’ বলে মনে করা মার্কিন দেশের একটা সমস্যা, তার নাগরিকেরা যে কোনও সঙ্কটের সামনে কেমন একটা উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে বাইরের শত্রু খোঁজেন। বিশ্বাসই করতে পারেন না, কোনও ‘চক্রান্ত’ ছাড়া তাঁদের দেশের কোনও বিপদ ঘনাতে পারে। সোজা কথা, আমেরিকা চায় ‘বাইরের শত্রু’। আর চিনবিরোধী মনোভাব তো তাদের ভেতরে গভীরে প্রোথিত। সুতরাং এই পুরো ঘটনায় ট্রাম্পের আসন আরও দৃঢ় হল বলেই মনে করা যেতে পারে। ‘আমেরিকা ফর আমেরিকানস’-এর প্রবক্তা স্বভাবতই এখন আরও বড় নায়ক। আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পাল্লা এমনিতেই ভারী, করোনাভাইরাস তাঁর রাজনীতির ওজন এক ধাপে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল। অনেকে অবশ্য এখনও আশা রাখছেন, মার্কিন অর্থনীতি বিরাট ঘা খাবে, আর তার ফলে টলোমলো হবে ট্রাম্পের আসন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এ রকম আচমকা সঙ্কটের আঘাত এলে হতাশ মানুষ একটা বাইরের শত্রুই খোঁজ করে, নিজের দেশের প্রশাসনের দিকে আঙুল তোলে না। সুতরাং, আরও বেশি রক্ষণশীলতার দিকেই বেঁকে যাবে রাজনীতির ধারা। বর্তমান নেতার বহু কুকর্ম চাপা পড়ে যাবে এই তালে। তাঁর অনেক ব্যর্থতা ও দুর্বলতারও একটা অজুহাত তৈরি হবে।

চিনের অবস্থাও তথৈবচ। প্রেসিডেন্ট শি বুঝে গিয়েছেন নরম ভাবে ক্ষমতার আসর ফেঁদে বসার এটাই সুবর্ণসুযোগ। সুতরাং উহানে বিপর্যয় এড়াতে না পারলেও বা সে জন্য প্রথম পর্বে যথেষ্ট তৎপর হতে না পারলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরে তিনি সেই অঞ্চলে দৌড়ে যেতে ভুল করেননি, যাতে মারণ-ভাইরাস কমে-আসার ‘সাফল্য’-এর সঙ্গে তাঁর নামটি শক্ত ভাবে যুক্ত হয়ে যায়। কেবল তা-ই নয়। বিরাট পরিমাণ চিনা মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এখন তড়িঘড়ি পাঠানো হচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত ইটালি ও স্পেনে। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নিজে প্রবল আক্রান্ত হলেও তারা অন্যদের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমেরিকা যখন দ্বার বন্ধ করে করোনাকে রোখে, চিন তখন উদ্ধারের হাত বাড়াতে কত আকুল। চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জ়াও লিজিয়ান টুইটারে বলেছেন যে তাঁর দেশ খুব ভাল করেই জানে কে দায়ী। জানে যে, উহানে করোনাভাইরাস এসে পৌঁছনোর মাধ্যম আসলে মার্কিন সেনাবাহিনী। সব মিলিয়ে, দেশের এমন দুর্যোগের পরও শি চিনফিংকে দেখাচ্ছে আরও একচ্ছত্র, তাঁর কর্তৃত্ববাদকে— আরও ‘মহান’।

বাস্তবিক, বিশ্ব-দাঁড়িপাল্লা চিনের দিকে আরও ঝোঁকে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। ইউরোপে ট্রাম্পের দেশের উপর বেদম খেপে উঠেছেন বিভিন্ন দেশের রথী-মহারথীরা। এই ভাবে আমেরিকা-ইউরোপ সংযোগ এক কথায় বন্ধ করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, একতরফা সিদ্ধান্তে? তাঁদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনটুকু বোধ করলেন না? এত স্পর্ধা? ‘‘এর পরেও আমেরিকা বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করবে? বলছে ইউরোপের অনেক প্রাক্তন মিত্র দেশ’’— জানিয়েছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, এমন এক সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট কেলি ম্যাগসামেন। ইউরোপের বিভিন্ন মহলে এখন আলোচনা চলছে, সত্যিই, তাতে পরিবেশ দূষণ থেকে প্যানডেমিক, সব ব্যাপারেই দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা আপাতত কেবল ‘একলা চলো রে’-তে বিশ্বাসী নয়, ‘কাউকে কভু লাই দিয়ো না’র মতো স্পর্ধিত, অসহিষ্ণু নীতি নিয়ে দাপাদাপিতে ব্যস্ত। কূটনীতিকরা বলছেন, আমেরিকার সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্কেই এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটবে। চিনের কি সুবিধে হবে তাতে?

আর রাশিয়ার? এই মুহূর্তে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যত নিজেকে সম্রাট বানানোর চেষ্টা করছেন। পুতিন যাতে আরও অনেক বছর (দশক?) প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা চলছে। এমন সময়ে পশ্চিমি বিশ্বে এসে পড়েছে করোনার করাল থাবা। সুতরাং তিনি এখন খুবই বিশ্বাসযোগ্য ভাবে দাবি করতে পারছেন, এই তো অস্থির আমেরিকা ও ইউরোপের অবস্থা, তাদের কে দেখে তারই ঠিক নেই— এই অবস্থায় তাদের জারি করা রাশিয়া-বিরোধী নিষেধাজ্ঞায় কাঁচকলা এসে যায় মস্কোর! তা ছাড়া, পুতিন জানিয়েছেন, গোটা বিশ্বেই যে জরুরি অবস্থা, তাঁর সরকার যথাসাধ্য শক্ত ভাবে আগলাচ্ছে দেশ। অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তার নামে অনেক কিছুই করা যাবে এখন তাঁর দেশে, প্রশ্নহীন। সবাই সব জানে, তবুও তাঁর আকস্মিক ঘোষণায় চমকে উঠল ক্রেমলিন। বিশ্বপরিস্থিতি দেখিয়ে তাঁদের প্রেসিডেন্ট বলে দিচ্ছেন, ২০২৪-এর পরও তিনি ক্ষমতায় থাকছেন। ২০২৪ সাল— মানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের চতুর্থ টার্মের শেষ। চার বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিয়ম নেই তাঁর দেশের সংবিধানে, তাই দরকারে সংবিধানই শুধরে নেবেন তিনি। সংবিধান সংশোধন যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ক্ষমতাক্ষুধার কাছে জলভাত, আজ তা কে না জানে।

আসলে ভাইরাসের মতোই, কিছু কিছু বিপদ সহজে চোখে ধরা দেয় না, অনেক দূর ঘনীভূত না হলে তা জানানও দেয় না। আজকের পৃথিবী জুড়ে যে উন্মাদ অসহিষ্ণু কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির দাপট, তার চরিত্রটাও অমনই। করোনাভাইরাস সেই অসুস্থ বিশ্ব-রাজনীতিকে একটা বিপজ্জনক স্তরে উঠিয়ে দিয়ে গেল— যত দূর বোঝা যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement