ছবি: এএফপি।
অপ্রাপ্তি মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করিয়া থাকে। এই না-পাইবার খেদ হইতে জাত আকাঙ্ক্ষা জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি হইয়া দাঁড়ায়। যাহা অধরা, তাহার পিছনেই সে ছুটিয়া চলে অনবরত। এমনকি যাহা কাম্য তাহা না পাইলে তাহার পরিবর্ত-প্রাপ্তিতেও সে তুষ্টি সন্ধান করে। এমনই তুষ্টিতে তুষ্ট ব্রাজ়িলের এক দম্পতি। তাঁহাদের আশ্চর্য একটি শখ আছে। তাঁহারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বেড়াইতে যান এবং নব বরবধূ বেশে নিজেদের ছবি তুলিয়া রাখেন। এই শখের পিছনে আছে একটি ইতিহাস। অপ্রাপ্তির ইতিহাস। তাঁহাদের যখন বিবাহ হইয়াছিল, সেই অনুষ্ঠানের কোনও ছবি তাঁহাদের নিকট নাই। সেই আক্ষেপ পূরণ করিতেই তাঁহাদের এই অভ্যাস। অভিনব অভ্যাস, সন্দেহ নাই। মানুষ, সম্ভবত একমাত্র মানুষই এমন অভিনবত্বের পরিচয় দিতে পারে, দিয়া থাকে। এই মানসিকতাও বোধ করি মানবচরিত্রের একটি অনন্য মাত্রা।
অনেক মানুষই জানে, তাহার যাহা যাহা করিবার সাধ ছিল তাহার অনেক কিছুই সে করিয়া উঠিতে পারে নাই। বস্তুত, যে মানুষ অত্যন্ত সফল বলিয়া পরিচিত, তাহার জীবনেও অপ্রাপ্তি থাকে, থাকা স্বাভাবিক, হয়তো অনিবার্য। যথার্থ বুদ্ধিমান সে-ই, যে অপ্রাপ্তিটুকু মানিয়া লইয়া বাকি জীবনকে যথাসাধ্য সফল করিবার চেষ্টা করে। এই বুদ্ধি প্রকৃতপক্ষে কাণ্ডজ্ঞানেরই নামান্তর। কিন্তু অনেকেই সেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পারে না। তাহারা অতীতকে আঁকড়াইয়া থাকে। এই আকাঙ্ক্ষা কাহারও কাহারও ক্ষেত্রে মনোবিকারের জন্ম দিয়া থাকে। যে মানুষ আপন অতীতের মধ্যেই বাস করিতে চাহে, সে অনেক সময় বর্তমানকে গ্রহণ করিতে পারে না। এমনকি কেহ কেহ মৃত প্রিয়জনের লাশ আগলাইয়া বসিয়া থাকেন, কারণ মৃত্যু নামক অমোঘ অতীত-স্রষ্টাকে তিনি স্বীকার করিতে পারেন নাই। ব্রাজ়িলের ওই দম্পতি আপাতদৃষ্টিতে এমন কোনও মনোবিকলনের শিকার নহেন। তাঁহারা কেবল বারংবার অপ্রাপ্ত অতীতের ‘অভিনয়’ করিয়া আনন্দ অর্জন করেন। নির্দোষ আনন্দ। তাঁহারা আনন্দে থাকুন। আরও অনেক বার বিশ্বের অনেক স্থানে নবদম্পতির ছবি উঠুক।
কিন্তু এই সত্য অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, এই ধরনের আচরণে এবং তাহার অন্তর্নিহিত ভাবনায় বিবিধ আশঙ্কার অঙ্কুর রহিয়াছে। প্রথমত, অতীতচারণায় মগ্ন থাকিয়া জীবন অতিবাহিত করিবার আশঙ্কা। মনকে চোখ ঠারিয়া নিজের কাছে একটি অজুহাত তৈয়ারির আশঙ্কা। অজুহাতটি হইল: অতীতের অপ্রাপ্তি, যে অপ্রাপ্তিকে অনেকেই বহিয়া বেড়ায়, এবং অপ্রাপ্তিকেই কাজ না করিবার চমৎকার কারণ হিসাবে তুলিয়া ধরে। নিজেকেও ভুল বোঝায়, জগৎসংসারকেও। অতীতের অপ্রাপ্তিকে পূর্ণ করিবার তাগিদে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে উপেক্ষা করে। দ্বিতীয় আশঙ্কাটি এক অর্থে গভীরতর। অতীতের পিছুটানে অনেক মানুষের ভবিষ্যৎ সমস্যাসঙ্কুল হইয়া উঠিতে পারে। কেবল আপনার ভবিষ্যৎ নহে, প্রিয়জনেরও। অনেকেই নিজের জীবনে যাহা ঘটে নাই, যে সাধ মিটে নাই, উত্তরপ্রজন্মের জীবনে তাহার পূরণ দেখিতে চাহে। এক জন পিতা ডাক্তার হইতে পারেন নাই বলিয়া সন্তানকে ডাক্তার করিবার জন্য প্রাণপাত করিয়া দেন। সন্তানের মধ্য দিয়া আপন ইচ্ছাপূরণের এই তাগিদ আসলে নিজের অতীতকে ‘অধিকার’ করিবার তাগিদ। অতীতকে তুলিয়া আনিয়া ভবিষ্যতে বসাইয়া দিবার তাগিদ। এই অতীত-বিলাস উদ্বেগজনক বইকি!