—ফাইল চিত্র।
পরিবেশ আগে, না ধর্মীয় ভাবাবেগ? বিতর্কটি পুরাতন। পরিবেশ আদালতকে ধন্যবাদ, ছটপূজা সংক্রান্ত তাহাদের সাম্প্রতিক রায় পরিবেশের পক্ষেই গিয়াছে। বস্তুত ছটপূজাকে কেন্দ্র করিয়া লড়াইটি শেষাবধি দাঁড়াইয়াছিল পরিবেশ বনাম রাজ্য সরকারের। বিকল্প ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ছটপূজা রবীন্দ্র সরোবরেই করিতে হইবে— এত কাল এই দাবি ছিল পুণ্যার্থীদের। অধুনা পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বয়ং সেই অন্যায় দাবিতে গলা মিলাইয়াছিল। কলিকাতা মেট্রোপলিটন ডেভলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ) সম্প্রতি পরিবেশ আদালতে রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে ছটপূজা করিবার ‘বিশেষ’ অনুমতি চাহিয়া আবেদন করিয়াছিল। কারণ, ইহার সহিত লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘আবেগ’ জড়িত। সেই আবেদন শুধুমাত্র যে পত্রপাঠ খারিজ হইয়াছে, তাহাই নহে, আবেদন করিবার জন্য যে তাঁহাদের অর্থদণ্ড হয় নাই, সেই কথা ভাবিয়াই সরকারি আইনজীবীদের আনন্দিত হওয়া উচিত বলিয়া আদালতের কড়া তিরস্কারও জুটিয়াছে।
রায় প্রসঙ্গে নাগরিক পরিসরে মন্তব্য শোনা যাইতেছে— কেএমডিএ-র আবেদনটি সরকারি দফতরগুলির নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালন না করিবার দীর্ঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ, কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নহে। সত্য। কেএমডিএ-র উপরই দক্ষিণ কলিকাতার ফুসফুস হিসাবে পরিচিত এই মনোরম সরোবরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বটি সমর্পিত, অথচ সেই রক্ষকই এখন ধ্বংসে ইন্ধন দিতেছে। যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, প্রবল ধর্মীয় ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করিতে যে কঠোর পদক্ষেপ করিতে হয়, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করিতে হয়, কেএমডিএ-এর সেই ক্ষমতা নাই, ইচ্ছাও নাই। গত বৎসর ছটপূজার নামে সরোবরে যে তাণ্ডব চলিয়াছিল, তাহাতেই সদিচ্ছার অভাবটি স্পষ্ট হইয়া যায়। বিকল্প ব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রবেশদ্বারের তালা ভাঙিয়া, হাজার হাজার ‘পুণ্যার্থী’ প্রবেশ করিয়া সরোবর চত্বরটিকে তছনছ করিয়াছিলেন। এবং প্রশাসন কার্যত দাঁড়াইয়া দেখিয়াছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলিয়াছিলেন, মানুষ না-জানিয়া চলিয়া গেলে কি তাহাকে লাঠিপেটা করা হইবে, না কি গুলি করিয়া মারা হইবে? লাঠিপেটার কোনও প্রশ্নই নাই, কিন্তু কী ভাবে সরকারি নির্দেশ বলবৎ করিতে হয়, তাহা সরকারের প্রধানেরই জানিবার কথা। এই বারও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম জানাইলেন, ধর্মীয় কার্যে বলপ্রয়োগ তাঁহারা চাহেন না বলিয়াই ছটপূজায় রবীন্দ্র সরোবরকে ব্যবহারের আবেদন জানানো হইয়াছে। যেন সত্যই বলপ্রয়োগ ভিন্ন সরকারি নির্দেশ কার্যকর করিবার কোনও পন্থা অবশিষ্ট নাই।
হয়তো প্রশ্নটি শেষ অবধি কার্যকর করিবার ‘পন্থা’র নহে, করিবার ‘ইচ্ছা’র। সরোবর নিষিদ্ধ করায় গত বৎসর যে মানুষেরা রাজ্য প্রশাসনের উপর খেপিয়াছিলেন, তাঁহারা এই বার না খেপিলে রাজনীতির অঙ্কেও কিছু বাড়তি সুবিধা হইত। কিন্তু পরিবেশ রাজনীতি বুঝে না, ভোট তো বুঝেই না। তাহার যেমন ক্ষতি হইবার, হইয়া যাইবে। রবীন্দ্র সরোবর জাতীয় সরোবর। এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন। ২০১৭ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালতের একটি রায়ে রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে সমস্ত প্রকার পূজার্চনা এবং সাউন্ডবক্স চালাইয়া, বাজি পুড়াইয়া মোচ্ছব বন্ধ করিবার কথা বলা হইয়াছিল। কেএমডিএ ও কলিকাতা পুলিশের উপর দায়িত্ব আরোপিত হইয়াছিল, যাহাতে সেই নির্দেশ মানিয়া চলা হয়। কিন্তু তাহা হয় নাই। পরিবেশ যেখানে বিপন্ন, সেখানে ঐতিহ্য অজুহাত হইতে পারে না। নাগরিককে বুঝাইতে হইবে। পুলিশকে তাহার কাজটি করিতে হইবে। ‘একটি দিন’-এর বিপুল আবর্জনা দিয়া সারা বৎসরের দূষণমুক্তির প্রচেষ্টাকে সরোবরের জলে নিক্ষেপ করা যাইবে না। সামনে আরও বড় উৎসব আসিতেছে। সেখানেও পরিবেশবোধ ও তাহার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যনিরাপত্তা বজায় রাখিবার দায় রাজ্য প্রশাসনেরই।