এখন সরকারি পরিচালনা আর প্রশাসনের মূল উপাদান: নাটকীয়তা

টিভিতে চাই আগ্রাসী ছবি

চার দশক আগে, ১৯৮০-র দশকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা দূরদর্শনই ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম।

Advertisement

অভিজিৎ কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

বছরখানেক আগে জনপ্রিয় অভিনেত্রীর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ঘটনার নিউজ় টেলিকাস্ট-এ দেখেছিলাম বাথটবে বুম-মাইক হাতে শায়িত সংবাদ পরিবেশক। সম্প্রতি দেখলাম, জলপাই পোশাকে হাতে খেলনা অটোমেটিক অস্ত্র সজ্জিত সংবাদ পরিচালক। সিমুলেট করা, বাস্তবের ছদ্মরূপ ঢুকে পড়ছে আমাদের ড্রইং রুমে। দুটো উদাহরণ দক্ষিণী টেলিভিশন চ্যানেল থেকে হলেও এর ব্যাখ্যা কিন্তু কাটআউট ও কাল্ট-ভক্তিসর্বস্ব দক্ষিণী সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। অধিকাংশ জাতীয় টিভি চ্যানেলের স্টুডিয়োর সমরসজ্জা বা সীমানা-রাজনীতির দৃশ্য পরিবেশনে গুলিয়ে গিয়েছে অগ্রণী সামরিক চরিত্রের সঙ্গে ‘নিউজ়’ পরিবেশক বা রাজনৈতিক ভাষ্যকার। চূড়ান্ত পরিহাসের সম্মুখীন হই যখন শুনি বিরল স্বাধীন মত পোষণকারী চ্যানেল সম্পাদক বলেন, আগামী দু’আড়াই মাস বাড়ির টিভি বন্ধ করে রাখুন, টিভি দেখবেন না, শান্তি পাবেন।

Advertisement

চার দশক আগে, ১৯৮০-র দশকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা দূরদর্শনই ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম। সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন নিউজ় ক্যাপসুলের স্বাদ আমরা পেতে শুরু করি ১৯৮৮ সালে, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ প্রোগ্রামে। দূরদর্শন পরিবেশিত হলেও আমরা উল্লসিত হয়ে উঠি সরকারি স্বরের বাইরের বিশ্বের খোঁজ পাওয়ায়। এর পর ছিল একমাত্র একটি সংবাদ চ্যানেলের গ্রহণযোগ্যতা। তার পর কেটে গিয়েছে তিন দশক। ভারতীয় গণমাধ্যম জগতে বিচ্ছুরণ ঘটেছে একটার পর একটা বেসরকারি নিউজ় চ্যানেলের। তথ্যভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে যে বহুস্বর, অভিমত ও প্রশ্ন উদ্‌যাপনের আশা ছিল, সে সবের বদলে এসেছে পর্যায়ক্রমে সাজানো ‘ব্রেকিং নিউজ়’-এ ঘটনার অবিরাম স্রোত। ভোক্তা দর্শকের কোণঠাসা অবস্থা। আর এই পরিস্থিতিকে দেখতে হবে রাষ্ট্র-গণমাধ্যম-সমাজের জটিল পরিপ্রেক্ষিতে।

আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হল গণমাধ্যম। তথ্য-যুক্তির বিন্যাসে সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই গণমাধ্যমের প্রাথমিক কাজ। রাষ্ট্র কী ও কেন, এ নিয়ে নানা ধারার বিতর্ক আছে। একতা বা অবিচ্ছিন্নতার প্রতীক হিসেবে কল্পিত হলেও রাষ্ট্রের একটা কাঠামোগত দিক আছে। রাষ্ট্র আর সমাজের মধ্যে বিভাজন কাম্য হলেও বাস্তবে এই বিভাজিকা বেশ ঘোলাটে। তবুও দৈনন্দিন সমাজের নানা খুঁটিনাটি ব্যবস্থাপনায় বা ব্যবহারিক চর্চায় আমরা একটা কাল্পনিক রাষ্ট্র-সমাজ বিভাজন বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

Advertisement

এখন চব্বিশ-সাত টেলিভাইজ়ড নিউজ় গণমাধ্যমের অগ্রণী স্বর হিসেবে সমাজ আর রাষ্ট্রের যোগসূত্রের কাজ করে। বিভাজনটা কাম্য, তাই এই যোগসূত্রের প্রস্তাবনা। দৃশ্য সহযোগে খবর পরিবেশন ধ্রুপদী গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের অঙ্গ। সমাজের নানা সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরবে সে। সরকার-পরিপন্থী কোনও দায়িত্ব পালন তার কাজ না হলেও সময়বিশেষে কঠিন প্রশ্নও তুলে ধরতে হয় রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী সরকারের কাছে। আবার সরকারি পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ডের বয়ানও সর্বজনের কাছে নিয়ে যাওয়া এই গণমাধ্যমের দায়। কতকটা গেটকিপার-এর কাজ করার কথা তার।

কী ভাবে সংবাদমাধ্যম যোগসূত্রের কাজ করছে, তার উপরই নির্ভর করে জনমানসে রাষ্ট্র-ধারণার গঠন। প্রাক-উপনিবেশ যুগে সমাজ পরিচালনায় আপেক্ষিক ভাবে অনেকটাই প্রান্তিক ছিল রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্বাধীনতা-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্র সরাসরি ভারতীয় সমাজে দণ্ডমুণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। বলা চলে, জনমানসে এক সদর্থক জায়গা করে নিয়েছে রাষ্ট্র-ধারণা। এর নেপথ্যে কোনও ম্যাজিক বা বিপ্লব নেই, আছে সংবিধান প্রণয়ন। জনগ্রাহ্য আর জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সূত্র সেই অমোঘ লাইনগুলো: ‘উই, দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া... গিভ টু আওয়ারসেলভস দিস কনস্টিটিউশন’— এই সংবিধান আমরা নিজেরাই নিজেদের দিলাম। তার পর বহু তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, কাটাছেঁড়া হয়েছে রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রই যে সমাজগঠন আর উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেবে, সেটা আমাদের ভাবনায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে।

যে সব শ্রেণির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা, তারা ভরসা করেছে এক ‌আধুনিকপন্থী ‘এলিট’-এর উপর। সমাজগঠনের পরিকল্পনা এদের মাথা আর হাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া গিয়েছিল। আলগা এক আদর্শগত কাঠামো এই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও সাবেক সম্প্রদায়যুক্ত ভারতবাসীর কাছে এই এলিট শ্রেণির ভাষা অচেনাই থেকে গিয়েছে। ঠিক এখানেই গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় প্রেক্ষাপটে সাবেক এডিটর, সাংবাদিককুলের ঐতিহাসিক অবস্থান ছিল ঈর্ষণীয়। সমীহ জাগানো বুদ্ধিবৃত্তির ফলে এঁরা এক আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিলেন। অনুভূতিজাত ন্যায়পরায়ণতা আর ঋজুতা অবলম্বন করে এঁরা বক্তৃতাবাগীশ নেতা আর রাজনৈতিক শ্রেণির কাছে আদায় করে নিয়েছিলেন সম্ভ্রম। জনহিত বা পাবলিক গুড-কে সামনে রেখে গণমাধ্যমের পথচলা। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাজনৈতিক শ্রেণিও বাধ্য হয় সেই বলিষ্ঠ স্বরকে কদর করতে।

পারস্পরিক সম্মান দেওয়ানেওয়ায় কোনও টানাপড়েন থাকবে না, তা হয় না। কিন্তু তা চূড়ান্ত রূপ পায় জরুরি অবস্থার সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর তার আগে-পরে এ দেশেও মুক্তিযুদ্ধ বা ‘সম্পূর্ণ’ বিপ্লবের আঁচ পড়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাধান্য পেয়ে গেল আনুগত্য তথা বশ্যতা। জনহিতের বদলে আনুগত্য, পাশাপাশি রাষ্ট্র আর সরকার সমার্থক হয়ে ওঠার বীজ সেই সময়েই পুঁতা। স্বাধীন দেশে প্রথম পর্বের ইউটোপিয়া ‘উন্নয়নের বাহক রাষ্ট্র’, আরও দেড় দশক বাদে নতুন বাঁকে এসে পড়ে। ইউটোপিয়ার নতুন মোড় ‘উন্মুক্ত বাজার নির্ভর’ সমাজ।

নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক ময়দান থেকে রাষ্ট্রের পিছু হটার বিউগল বাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণিও বকলমে বাজারের মালিকের বশ্যতা মেনে নেয়। মার্কেট ম্যানেজারের উত্থান একতরফা ভাবে বদলে দিতে থাকে গণমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশকে। রাজনৈতিক শ্রেণি এ দেশে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব অনেকটাই ছেড়ে রেখেছিল আলোকপ্রাপ্ত এলিট শ্রেণির হাতে। সেই স্বতন্ত্র এলিট-স্বরও এ বার কোণঠাসা হতে থাকে। জাতীয় পরিসরে বদলে যেতে থাকে গণমাধ্যমের পেশাদারি মূল্যবোধ। ব্যবসায়িক শ্রেণি বাজারের ব্যাকরণমতো তথ্য-যুক্তি-খবরের চেয়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসে জনপ্রিয় অনুভব। মার্কেট রিসার্চের মূল উদ্দেশ্য জনপ্রিয় তথ্য সংগ্রহের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় রুচি আর সেই মতো চাহিদা তৈরি করা। মুনাফা-রাজনীতি-প্রচার— ত্রিকোণ আঁতাতের এই হল আদর্শ সময়।

নিজেকে অন্য ভাবে দেখছে নয়া সমাজ। দীর্ঘমেয়াদি ঘটনার পরম্পরা আর সম্পর্কের নিরিখে উপলব্ধিতে আসার চেয়ে দৃষ্টি-আকর্ষক ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষকে টানছে যোগাযোগ মাধ্যমের পর্দার সামনে। অর্থাৎ খবর হয়ে উঠতে হবে দৃশ্যমান। তাই আজ জনপ্রিয়তার শিখরে টেলিভিশন নিউজ়। নয়া মিডিয়া চাইছে ইভেন্টস, ‘স্পেকটাকুলার’ নাটকীয়তা। তাই সরকার পরিচালনা, শাসনপদ্ধতিও হয়ে উঠতে চাইছে দৃশ্যমান ঘটনার ঘটক।

জনজীবনে সঙ্কট বা অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষ তার পরিপূরক খোঁজে কল্পজগতে। সমাজ বা ব্যক্তিজীবনে অক্ষমতা আর দুর্বলতা ঢেকে দিতে পারে ইমেজ দুনিয়া। সেই ইমেজ দুনিয়ার দখল নিয়েছে নিউজ় চ্যানেল। সেখানেই জনতা খুঁজছে অদম্য, সফল বা মারমুখী প্রতিনিধিকে। রাষ্ট্র ও সমাজের যে নয়া সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার নিরিখেই দেখতে পাচ্ছি এই আগ্রাসী জনপ্রতিনিধির উত্থান। নিউজ়ের পর্দায় আগ্রাসী ইমেজের সাহায্যে ছদ্মবেশে একই সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে আর গড়ে তোলাও হচ্ছে যৌথ নাগরিক আত্মসমর্পণ। ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ আর ইমেজ বর্ষণের যৌথ অভিযানে গুলিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজ বিভাজনরেখা।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement