মুখ ঘুরিয়াছে স্রোতের। বেসরকারি বিদ্যালয় হইতে পড়ুয়ারা ফিরিতেছে সরকারি স্কুলে। একটি অসরকারি সংস্থার জাতীয় সমীক্ষায় (অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট) এই তথ্য প্রকাশিত হইয়াছে। দীর্ঘ লকডাউনে অভিভাবকদের কর্মহীনতা, এবং তজ্জনিত আর্থিক সঙ্কট, সরকারি বিদ্যালয়ের নিকটবর্তিতা— এই কারণগুলি জনগোষ্ঠীর একাংশকে ফের সরকারি স্কুলমুখী করিতেছে বলিয়া অনুমান। ঘোর দুর্ভাগ্যের মধ্যে একটি সুযোগের উদয় হইয়াছে। তাহা সরকারি স্কুলশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করিবার, অভিভাবকের আশ্বাসস্থল হইয়া উঠিবার সুযোগ। সরকারি স্কুল হইতে গত দুই দশকে দেশবাসী ক্রমে মুখ ফিরাইয়াছেন। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার মান, নিয়মানুবর্তিতা, আদবকায়দা, সর্বোপরি ইংরাজি শিক্ষার প্রলোভন অভিভাবকদের আকর্ষণ করিয়াছে। তাহার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকট হইয়াছে বৈষম্য, যাহা সামাজিক অসাম্যকে আরও ভয়ানক করিতেছে। ব্যয়সাধ্য বেসরকারি শিক্ষা ধনীর এবং বিনাখরচে সরকারি শিক্ষা দরিদ্রের, এই বিভাজন তৈরি হইয়াছে। সমাজে তাহার প্রভাব এমনই প্রসারিত হইয়াছে যে, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলিও সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করিয়া বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠাইতেছে। ইহার ফলে তৈরি হইয়াছে দ্বিতীয় সঙ্কট, সামাজিক সুরক্ষার। সরকারি ব্যবস্থায় স্কুল কেবল শিক্ষাদানের স্থান নহে। শিশুর দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের সার্বিক দায়িত্ব বিদ্যালয়ের। দরিদ্রের শিশু দ্বিপ্রাহরিক সুষম আহার, পাঠ্যবই, জামা-ব্যাগ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা হইতেই বঞ্চিত হয় সরকারি স্কুলে যাইতে না পারিলে।
এই সকল বঞ্চনা অভিভাবকেরা উপেক্ষা করেন, কারণ তাঁহাদের নিকট শিক্ষার উন্নত মান অধিক প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হয়। দুর্ভাগ্য, সরকারি স্কুলগুলি পঠনপাঠনে যথাযথ মানের আশ্বাস দিতে পারে নাই। শিক্ষকদের কাজের পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের অভাবে উদ্যোগী, সৎ শিক্ষকেরাও নিরুৎসাহ হন। শিক্ষা দফতরের একতরফা সিদ্ধান্ত চাপাইবার প্রবণতা, স্কুলশিক্ষা কমিটি গঠনে সরকারের অনিচ্ছা, এবং শিক্ষক সংগঠনগুলির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিবার অভ্যাস, এই সকলই সরকারি স্কুলকে দুর্বল করিয়াছে। শিক্ষকদের সামাজিক ভাবমূর্তিও পূর্বের গৌরব হারাইয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, যে করোনা-বিধির কারণে স্কুল বন্ধ, তাহা অগ্রাহ্য করিয়া বহু সরকারি স্কুলের শিক্ষক নিজের বাড়িতে ছাত্রদের ক্লাস করাইতেছেন, অবশ্যই কাঞ্চনমূল্যে।
অর্থাভাবে বেসরকারি স্কুলগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন, কার্যক্ষমতা ব্যাহত। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শিশু অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পাইয়াছে। পাঠ্যবইও এ বৎসর সকল শিশুর নিকট পৌঁছায় নাই, বেসরকারি স্কুলের তুলনায় সরকারি স্কুলে অধিক পৌঁছাইয়াছে। দীর্ঘ অনভ্যাসে বহু শিশু অধীত পাঠ ভুলিয়াছে। এই চরম শিক্ষা সঙ্কটের মুখে দাঁড়াইয়া সরকারি স্কুল কি ঘুরিয়া দাঁড়াইবে না? এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে হইলে এক দিকে শিক্ষা দফতরকে নমনীয় হইতে হইবে, স্কুল পরিচালনায় সিদ্ধান্ত লইবার অধিক সুযোগ দিতে হইবে স্কুলগুলিকে। অপর দিকে স্কুলগুলিকেও ছাত্রদের রোগ-নিরাপত্তা ও শিক্ষার প্রয়োজনের প্রতি অধিক মনোযোগী হইয়া কার্যপদ্ধতি স্থির করিতে হইবে। স্কুলে মানবসম্পদ রহিয়াছে, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও শৃঙ্খলা।