প্রতীকী ছবি
লকডাউনের ধাক্কায় যাঁহারা শহর ছাড়িয়া গ্রামে ফিরিলেন, ফিরিতে চেষ্টা করিলেন, চেষ্টা করিয়াও ফিরিতে পারিলেন না— সেই জনগোষ্ঠী গত দুই মাস যাবৎ সংবাদ শিরোনামে। যথার্থ কারণেই— লকডাউন এই পরিযায়ী শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে যে ভাবে বিপর্যস্ত করিয়াছে, ভারতের ইতিহাসে তাহার তুল্য বিপর্যয় বিরল। কিন্তু আরও একটি জনগোষ্ঠীর বিপন্নতার কথা তুলনায় আড়ালেই থাকিয়া গেল। সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী, লকডাউন-জনিত যাবতীয় বিপন্নতা সহ্য করিয়াও যাঁহারা শহরেই থাকিয়া গেলেন। হয়তো ফিরিবার ন্যায় গ্রাম নাই বলিয়াই। শহরের দারিদ্র একমাত্রিক নহে— যাঁহারা বারো ঘর এক উঠানের বস্তিতে থাকেন, আর যাঁহারা ফুটপাতেই দিন গুজরান করেন; যাঁহারা শহরের উপান্ত হইতে প্রত্যহ কেন্দ্রে আসেন জীবিকার সন্ধানে, আর যাঁহারা শহরের কেন্দ্রস্থলেই কোনও ক্রমে মাথা গুঁজিবার ঠাঁই করিয়া লহেন— তাঁহাদের দারিদ্রের চরিত্র, তীব্রতা, মাত্রা, সবই পৃথক। এই মুহূর্তে বিপন্নতা তাঁহাদের মিলাইয়াছে। ঘটনা হইল, দিল্লীশ্বরের বাম মুষ্টি গলিয়া যদিও বা গ্রামীণ দরিদ্রের জন্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা হইয়াছে, শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখনও অপেক্ষায়। সম্প্রতি সিপিআইএম দাবি করিল, শহরাঞ্চলেও কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার কাজ আরম্ভ করা হউক। দাবিটি অযৌক্তিক নহে। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থাও করা যাইতে পারে। কোনও না কোনও পথে আর্থিক সাহায্য পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে।
কেন, তাহার দুইটি অতি স্পষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণ রহিয়াছে। প্রথমত, গ্রামীণ দরিদ্রের সহিত শহরের দরিদ্রের মূল ফারাক— শহরের গরিব মানুষ বাজার অর্থনীতির চক্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। গ্রামে কৃষি আছে, যাহাতে ক্ষুণ্ণিবৃত্তির ব্যবস্থাটুকু হইতে পারে। তাহা ব্যতীত, গ্রামে একটি সামাজিক নেটওয়ার্কও আছে, যাহা বহু প্রজন্মের সহাবস্থানের ফসল। কেহ বিপন্ন হইলে সেই সামাজিক সুরক্ষা জাল তাঁহাকে অনেক দূর অবধি বাঁচাইয়া রাখিতে পারে। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহদংশ বহিরাগত, ফলে তাঁহাদের সেই সামাজিক সুরক্ষা জালটি নাই। অন্ন সংস্থানের জন্য বাজারের উপর নির্ভর করা ভিন্নও তাঁহাদের উপায় নাই। অর্থনীতির চাকা থমকাইয়া গেলে তাঁহাদের আয়ের পথ বন্ধ; বাজার-বহির্ভূত সংস্থান না থাকার ফলে তাঁহাদের পাতেও প্রত্যক্ষ টান পড়া স্বাভাবিক। লকডাউনে শহরের গরিব মানুষ এই ভাবেই বিপন্ন। দেশের সর্বত্র। বস্তুত, বিশ্বের সর্ব প্রান্তেই ছবিটি এক রকম। ফলে, তাঁহাদের কথা আলাদা করিয়া ভাবিতে হইবে বইকি।
দ্বিতীয়ত, গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলিতেছে, শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসতিতে কোভিড-১৯ অতিমারি ভয়াবহ আকার ধারণ করিতেছে। নিউ ইয়র্কের কুইন্স বা ব্রঙ্ক্সে যেমন, মুম্বইয়ের ধারাভি বা আমদাবাদের বস্তি অঞ্চলেও তেমনই। তাহার এক দিকে রহিয়াছে সেই বসতিগুলির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ— স্থানাভাব, শৌচাগার ও নিকাশির অব্যবস্থা ইত্যাদি। অন্য দিকে আছে জীবিকার সঙ্কট। এই মানুষগুলির সিংহভাগেরই পেশার ধরন এমন, যেখানে কাজে না যাইতে পারিলে বেতনও নাই। ফলে, বাধ্য হইয়াই তাঁহারা সংক্রমণের ঝুঁকি লইয়াও কাজে বাহির হইতেছেন। ইহাতে তাঁহাদের বিপন্নতাও যেমন বাড়িতেছে, তেমনই অন্যান্যদের মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়িতেছে। এই জনগোষ্ঠীকে যদি ন্যূনতম আর্থিক সাহায্য করা হয়, তবে তাঁহাদের কাজে যাইবার বাধ্যবাধকতা খানিক হইলেও কমে। তাহাতে শহরও তুলনায় নিরাপদ হয়। কাজেই, দরিদ্রের স্বার্থে এবং অন্যান্যদের স্বার্থেও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ভাবা প্রয়োজন। সংক্রমণ সরকারি দীর্ঘসূত্রতার তোয়াক্কা করে না। অভাবের তাড়নাও নহে।