পেরিয়ে গিয়েছে ধৈর্যের সীমা, প্রতি মুহূর্তে বাঁচতে হবে আতঙ্কিত হয়ে?

অপরাধীর শাস্তির পাশাপাশি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হোক মেয়েদের। দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। লিখছেন অনিন্দিতা গুপ্ত রায়‘থিওরাইজ’ করে, তত্ত্ব আওড়ে, মনস্তত্ত্বের নানা দিক বিশ্লেষণ করে, ‘সিস্টেম’ পাল্টানোর কথা বলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলে তুলে মুখে রক্ত উঠিয়ে চিৎকার করে করেও কিছু কি বদল ঘটল?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৩৫
Share:

প্রতীকী চিত্র।

যথেষ্ট হল। ধৈর্যের শেষ সীমা পার করে দাঁড়িয়ে একটাও অক্ষর লিখতে পারছি না আর। কোন শব্দে প্রতিবাদ জানাব, কোন ভাষায় চিৎকার করব, কোন অক্ষরে উপুড় করে দেব সবটুকু ঘৃণা-কান্না-ক্রোধ-অসহায়তা— সত্যিই জানি না। লিখে কী হবে? লিখে কি আদৌ কিছু হবে? ছাই না ওড়া অবধি, রক্তস্রোত গড়িয়ে এসে নিজেদের জামাকাপড়ে না লাগা অবধি কী নির্বিকার অভ্যেসেকাগজের পাতা উল্টিয়ে ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে দেখে নিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা লাইফস্টাইলের পাতায়।

Advertisement

কেনই-বা যাব না— প্রতিদিন তিন থেকে তিয়াত্তরের এই ‘মেয়েছেলে’দের নিয়ে ‘খবর’ আর কত পড়া যায়? ছোঃ! চলুন, বরং ভোটবাক্সে হিসেব কষি কোন মহামান্য নেতানেত্রীর পাল্লা উঠল, নামল! রাজ্যের প্রধানদের মান অভিমান, তর্ক বিতর্ক নিয়ে মিম শেয়ার করি বরং। পৌরাণিক বনাম ঐতিহাসিক চরিত্রের কূটতর্কে কয়েকশ একরের রায়দান নিয়ে টান টান বসে থাকি। জাতপাতের লড়াইয়ে আহা-তু-তু করে লড়িয়ে দিই বুভুক্ষু জনতাকে। আর দিব্যি ভুলে থাকি আমাদের এই হঠাৎ কোনও বড়সড় ঘটনা না ঘটা অবধি জাগ্রত হওয়া বিবেকটিকে। তারপর চলুন মোমবাতি হাতে রাস্তায় নামি। আলোচনাচক্রও বসতে পারে এই উপলক্ষে— ‘সব নরাধমদের মৃত্যুদণ্ড চাই-ই চাই!’ ‘আমরা আজ থেকেই আর যেন কেউ কোন রেপ-রেটোরিক ব্যবহার না করি!’। ‘আরে ঘরে-বাইরে মেয়েদের বাছা বাছা সম্বোধনে ডাকা শুনেও আমরা তো বেশ চুপচাপ। এগুলো বন্ধ করলেই হু হু করে ধর্ষণ কমে যাবে!’ ‘আচ্ছা নাচের স্কুল তুলে দিয়ে ক্যারাটে স্কুল চালু করলে হয় নাশ’ ‘সব মেয়েরা অস্ত্র রাখলেই তো পারে!’ ‘মেয়েরা জামাকাপড় পরবে অশালীন, আর দোষ হবে ধর্ষকের? এগুলো পাল্টানো দরকার কি না, আপনারাই বলুন!’ ‘না না! আসলে ঘর থেকেই শিক্ষা চালু করা দরকার। ঘরের ছেলেদের শেখান মেয়েদের সম্মান করতে’ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। আর এই সব আলোচনা, দাবিদাওয়া, তর্কবিতর্কের আড়াল দিয়ে সারা দেশ জুড়ে দিনে গড়ে কয়েকশো মেয়ে ধর্ষিত হয়ে যাবে, জানতেও পারব না আমরা। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত চা বাগান-বা রেলকলোনির ঝুপড়ি ঘরে চার বছরের বাচ্চার খোবলানো ধর্ষিত শরীরের রক্তফোঁটা নিউজপ্রিন্টের কালো অক্ষরের গায়ে এসে লাগলে শিউরে উঠে স্তম্ভিত হয়ে নিজেদের ঘরের শিশুকন্যাটিকে হয়তো একবার বুকে চেপে ধরব আতঙ্কে! ক্রমশই বাচ্চাদেরও শেখাতে বাধ্য হব— ‘বিশ্বাস করো না কাউকে। সাবধান হও। তুমি আসলে শরীর। ভোগ্য ছাড়া কিছু নও!’

‘থিওরাইজ’ করে, তত্ত্ব আওড়ে, মনস্তত্ত্বের নানা দিক বিশ্লেষণ করে, ‘সিস্টেম’ পাল্টানোর কথা বলে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলে তুলে মুখে রক্ত উঠিয়ে চিৎকার করে করেও কিছু কি বদল ঘটল? সংসদ ভবনের সামনে বসে পড়া প্ল্যাকার্ড হাতে মেয়েটির মতোই প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই মহান রাষ্ট্র, মহামান্য নীতি নির্ধারকদের দিকে, ইচ্ছে হলে ব্যবস্থা নিতে পারেন। শুনুন, চিৎকার করে জানতে চাইছি— কেন মেয়ে হয়ে জন্মে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে বাঁচতে হবে আমার মতো আরও অসংখ্য মেয়েকে? কী নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন আপনারা আমাদের জন্য? দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জানতে চাই— এই বিষয়ে কতবার দেশ অচল করেছেন, সংসদ স্তব্ধ করেছেন, মিছিল জারি রেখেছেন নিজেদের স্বার্থের উপরে উঠে? না কি এ সবই বড্ড ছেঁদো কথা, মেয়েলি বিষয়? তা হলে চুপ করে থাকুন আর প্রশ্ন করলে কানের পর্দা ফেটে না যাওয়া অবধি শুনুন। থামানোর চেষ্টা করবেন না দয়া করে। ভোট দিই, কর দিই, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবেই জানতে চাইছি, দেশের অর্ধেক জনসমাজ ভোট বয়কট করলে, সর্বতো ভাবে অসহযোগিতা করলে আপনাদের সকলের ক্ষমতার সব রয়াসন বজায় থাকবে তো?

Advertisement

জানি, ধর্ষণ ক্ষমতারই আস্ফালন আসলে। দমিয়ে রাখার, পেষণ করার, নিপীড়ন করার এবং মুখ বন্ধ করার জন্য সবলের সমস্ত রকম অক্ষম পেশিশক্তির চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক প্রকাশ। অপেক্ষাকৃত শারীরিক দুর্বলকে অথবা সবলকে সম্মিলিত ভাবে জোর খাটিয়ে এই প্রক্রিয়া চলে। সেই জন্যই নারী, শিশু, পশু এবং পুরুষও ধর্ষিত হন— এ সব অনেক আলোচিত কথা। কিন্তু গত কয়েক বছরে অজস্র জানা-অজানা মেয়েদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চলেছে, পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এর ভয়াবহতা। তাইই মেয়েদের পক্ষ নিয়েই জানতে চাইছি!

যে চূড়ান্ত ভোগবাদের পৃথিবীতে পা দিয়ে আছি আমরা, সেখানে এক দিকে প্রবল ভাবে নানা লোভের ও কামনার উপকরণের সুলভ উপস্থিতি, অন্য দিকে জমছে সেগুলো দেখেও আয়ত্তে না থাকার ভয়ঙ্কর অবদমনজনিত লালসা, ক্রোধ, বিধ্বংসী-আগ্রাসী নিষ্ঠুরতা। একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর তাকে ভয়ানক ভাবে হত্যা করার প্রবণতা বাড়ছে। কী ভাবে আটকানো সম্ভব একে? যারা এইসব ঘটনায় জড়িত, তাদের অনেকেরই প্রথাগত শিক্ষা নেই বা অভিভাবকের পক্ষ থেকে সচেতন করার মতো পরিস্থিতিই নেই। তাই শিক্ষা দিয়ে, ছোট থেকে সচেতন করার কথা বলে সমাজ বোধ হয় আমরা পাল্টাতে পারছি না। রক্তবীজের ঝাড়ের মতো, রোগবাহী পতঙ্গের মতো হুহু করে বেড়ে যাওয়া অপরাধমনস্কদের ধরে দু’একজনকে ফাঁসিকাঠে ঝোলালে সত্যিই সমাধান সম্ভব? নিশ্চিত বলা যাবে, আর ঘটবে না এমন ঘটনা তার পর? তাইই রাষ্ট্রের কাছেই দাবি— নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। অপরাধীর শাস্তির সঙ্গে অপরাধপ্রবণতা রুখে দেওয়ার কাজেও সচেতন পদক্ষেপ করা হোক। দেশের সীমানার সুরক্ষার মতো দেশের নারীর নিরাপত্তার খাতিরেও না হয় আরেকটু বরাদ্দ বাড়ানো হল! কী ভাবে তা করাবে যাবে, তা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আইনব্যবস্থা ও আইনরক্ষক উভয়ের উপর ভরসা আর আস্থা নিয়েই বাঁচতে চাই আমরা, সুনিশ্চিত করতে চাই আগামী প্রজন্মের প্রতিটি শিশু, প্রতিটি কন্যাসন্তানের বেঁচে থাকা।

‘বেটি’ বাঁচাতে চাই আমরা সত্যিই, বিশ্বাস করুন! সমস্ত মেয়েরা একদিনের জন্যও মুখ ফেরালে, সমস্ত কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিলে অনেক দিনের জন্য সমাজ স্তব্ধ হয়ে যাবে এ পৃথিবীর! মেয়েরা প্রস্তুত। কারণ, মেয়েদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে! আপনারদের?

(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement