ফাইল চিত্র
পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি তাহার অস্তিত্বের সাত দশকাধিক কালে বহু সঙ্কট দেখিয়াছে। দেশভাগজনিত শরণার্থীর স্রোত, তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হইয়া যাওয়া বিস্তীর্ণ জনবসতি, বাৎসরিক ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব— বিপদ কাহাকে বলে, পশ্চিমবঙ্গ জানে। তবুও, ২০২০ সাল রাজ্যকে যে বিপদের সম্মুখীন করিয়াছে, তাহার তুলনা এই রাজ্যের ইতিহাসে নাই। বস্তুত, তেমন নিদর্শন গোটা দেশেই বিরল। অতিমারির প্রকোপে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন, লকডাউনের ফলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত; আমপানের তাণ্ডবে চারটি জনবহুলতম জেলা বিধ্বস্ত; এবং, ভিন্ রাজ্য হইতে ফিরিয়া আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের পুনর্বাসনের সমস্যা ও তাঁহাদের মাধ্যমে রোগ ছড়াইবার বিপুল সম্ভাবনা— পশ্চিমবঙ্গে এখন ত্র্যহস্পর্শযোগ। দুর্ভাগ্যের ধর্ম মানিয়াই এই বিপদগুলিও বহুলাংশে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের অতীত। পশ্চিমবঙ্গকে এখন সম্পূর্ণ নূতন করিয়া গড়িয়া তোলা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। আমপান-বিধ্বস্ত জেলাগুলিতে পরিকাঠামো হইতে নাগরিকের জীবিকা, কৃষি হইতে বিদ্যালয়, সবই যেমন ফের গড়িতে হইবে, তেমনই অর্থনীতিকেও ফের সচল করিতে হইবে। বন্ধ হইয়া যাওয়া, ধুঁকিতে থাকা ব্যবসা চালু করা; পরিবহণ পরিকাঠামোকে সচল করা; মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা— দায়িত্ব অনেক। সেই দায়িত্ব সরকার কী ভাবে পালন করে, তাহার উপর নয় কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
এই তিনটি বিপদের একটিকেও সম্পূর্ণ ভাবে সামলাইতে পারাই অতি দুরূহ কাজ। তদুপরি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করিয়া তুলিয়াছে রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারে চাপিয়া আমপান-বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করিয়া গেলেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্য এখনও আসিয়া পৌঁছাইল না। অদূর ভবিষ্যতে আসিবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেহ অনুমান করিতেছেন, এই দীর্ঘসূত্রতার সহিত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রত্যক্ষ যোগ আছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও রাজ্যের হাত-পা বাঁধিয়া দিল কেন্দ্রীয় সরকার, রেল দফতর। রাজ্যে কখন কত জন পরিযায়ী শ্রমিক আসিবেন, সেই সিদ্ধান্তের অধিকার যদি রাজ্যের না থাকে— বস্তুত, যদি শ্রমিকরা ট্রেনে চাপিবার পর রাজ্য প্রশাসন সেই সংবাদ পায়— তবে রোগ নিয়ন্ত্রণের কাজটি কঠিনতর হয়। অবশ্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গ নহে, এই সমস্যার মুখে পড়িয়াছে দেশের বহু রাজ্য। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকে অবজ্ঞা করিয়া, জিএসটি-র পূর্বশর্ত সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া রাজ্যগুলির আর্থিক বরাদ্দ বিষয়েও কেন্দ্র যে অবস্থান গ্রহণ করিয়াছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের বিপদ বাড়াইয়াছে বহু গুণ। এক দিকে প্রকৃতি, আর অন্য দিকে রাজনীতি— পশ্চিমবঙ্গকে এখন দুই বিরূপতা সামলাইতে হইতেছে।
কাজটি কঠিন, কিন্তু, হাল ছাড়িয়া দিলে চলিবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনকে বহুবিধ প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়াইয়া কাজ করিতে হইতেছে। সেই কথা মাথায় রাখিয়াও বলিতে হয়, কিছু বড় গাফিলতি থাকিয়া গেল। লকডাউনের সিদ্ধান্তক্রম লইয়া যেমন প্রশ্ন উঠিয়াছে, তেমনই শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারেরও আরও বেশি বিবেচনা প্রত্যাশিত ছিল না কি? পরিযায়ীরা ফিরিবেন, সেই সম্ভাবনা মাথায় রাখিয়া তাঁহাদের জন্য কি অধিকতর কোয়ারন্টিন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা যাইত না? জেলায় জেলায় বন্ধ থাকা স্কুলবাড়ি ভাড়া লইয়া কাজটি করা যাইত। ব্যবস্থা করা যাইত আরও বেশি স্বাস্থ্যপরীক্ষার। আমপানের কথাও যখন যথেষ্ট পূর্বেই জানা ছিল, তখন তাহার জন্যও আরও বেশি প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সক্রিয় করা দরকার ছিল। পরিস্থিত কঠিন বা কেন্দ্র অসহযোগিতা করি রাজ্য করিতেছে, ইহা বলিয়া তো মানুষের কষ্ট লাঘব করা যায় না। সীমিত ক্ষমতা ও সম্পদেরও প্রকৃষ্টতর ব্যবহার সম্ভব।