পর্ষদ বলিল, বানান ভুল হইলে নম্বর কাটা যাইবে না। সত্যই তো, যে ছাত্র বিষয়টি জানে, কিন্তু লিখিবার সময় বানান গুলাইয়া যায়, তাহার নম্বর কাটা যাইবে কেন? কত বড় বড় সাহিত্যিক রহিয়াছেন, অসামান্য কাহিনি বা কাব্য লিখিতেছেন, কিন্তু বানান ঠিক করিতে করিতে প্রুফ-সংশোধনকারীদের মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে। তাহাতে কি কাব্যের মান পড়িয়া যাইতেছে? যুক্তিগুলি আপাত ভাবে ঠিক মনে হইতে পারে; বানান যে বহু ছাত্রছাত্রীর নিকট এক বিভীষিকা, সেই বাস্তববোধও এই যুক্তিগুলির সমর্থনে আসিয়া দাঁড়াইতে পারে। মুশকিল হইল, এই যুক্তিদানের পিছনে যে মানসিকতা, তাহা লইয়া। কোনও ভুলকে ‘ঠিকই আছে’ বলিয়া চালাইবার মানসিক অভ্যাসটি কেবল মন্দ নহে, বিপজ্জনক। যে কাজ করিতে হইবে, তাহা ভাল করিয়া করাই ভাল। এবং যে কাজ ভাল করিয়া করা সম্ভব, তাহা ভাল না করিয়া করিবার মধ্যে কোনওই গৌরব নাই। আর, অযত্নের কাজকে পুরস্কৃত করিবার অভ্যাসটি তো আরওই বিপজ্জনক। তাহা, জাতি হিসাবে এবং মানুষ হিসাবে নীচে নামিবার অব্যর্থ যাত্রার উপর সিলমোহর দিবার বন্দোবস্ত।
ভাবিলে দেখিব, আমরা যখন পোশাক পরি, তখন কেবলমাত্র গাত্র আবৃত করি না, তাহার মধ্যে একটি শ্রী ও পারিপাট্য বজায় রাখিবারও চেষ্টা করি। পোশাকে কী-ই বা আসে যায়— এমন দার্শনিক অবস্থান থাকিতেই পারে, কিন্তু জনসমক্ষে বিস্রস্ত হইয়া বাহির হইবার তুলনায়, সুবিন্যস্ত হইয়া বাহির হইলে সকল পক্ষেরই স্বস্তি। যখন খাইতে বসি, খাবারগুলিকে যেমন-তেমন করিয়া টেবিলে ছুড়িয়া দিলেও সেগুলির পুষ্টিগুণ ও স্বাদ একই থাকিবে, কিন্তু আমরা থালায় সুসজ্জিত করিয়া তাহা দিতে ও পাইতে ভালবাসি। আমাদের সমাজজীবনে ও নন্দনচেতনায়, কাজে ও অবসরে, একটি সুষমার চাহিদা রহিয়াছে। যখন কেহ একটি উত্তর লিখিবে, তখন সেই উত্তরটি তাহাকে লিখিতে হইবে সুসংবদ্ধ ভাবে, দেখিতে হইবে, যতিচিহ্ন ও বানান ঠিক আছে কি না। শিক্ষার অর্থই হইল, জ্ঞানের দিকে, এবং জ্ঞানের শুদ্ধতার দিকে যাত্রা। তাই ছাত্রকে যদি বলিয়া দেওয়া হয়, একটি শব্দ কী ভাবে লিখিত হয় তাহা জানিবার দরকারই নাই মোটে, কেবল উচ্চারণটি যেন তেন প্রকারেণ বুঝালেই হইল, তখন অশুদ্ধতাকেই আশকারা দেওয়া হইল। নিষ্ঠার অভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া হইল। পিঠ চাপড়াইয়া বলা হইল, ফাঁকিবাজি এবং যত্ন, ইহার মধ্যে কোনও গুণগত প্রভেদ নাই। মুড়ি ও মিছরি একই দর।
সুতরাং বানানের ক্ষেত্রে, শুদ্ধতার প্রতি সম্মান যদি নষ্ট হইয়া যায়, জানা এবং না-জানার দাম যদি একই ধার্য হয়, তাহা হইলে, বাস্তবিক, মনুষ্যজীবনের সহিত মনুষ্যেতর জীবনের প্রধান পার্থক্যটিই ধসিয়া যাইতে বসে। কেহ বলিতে পারেন, এত কষ্ট করিয়া ‘মনুষ্য’ হইতে চাহিয়া লাভ কী। বিষম প্রশ্ন বটে। তবে কিনা, মনুষ্য হওয়া না-হওয়ার মধ্যে যদি আদৌ কোনও পার্থক্য খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব হয়, সে ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রতি এতখানি অশ্রদ্ধা রাখিলে চলিবে না। যে ব্যক্তি শিক্ষা পাইয়াছে, কষ্ট করিয়া শিক্ষাকে অধীত করিয়াছে, তাহাকে শিক্ষাবিরহিত মানুষটির সহিত এক তলে রাখিলে চলিবে না। ভাষা শিখিতে আসিয়া যে বানান শিখে নাই, সে ভাষার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হয় নাই বলিয়াই বানান শিখে নাই। এই অশ্রদ্ধাকে পুরস্কার দেওয়া যাইতে পারে না। আমরা যদি ভাবি যে, শ্রদ্ধাবান জ্ঞান লাভ করে করুক, কিন্তু অশ্রদ্ধাবানও নম্বর লাভ করে— তবে নম্বরের কোনও অর্থ নাই, নিজেদেরও কোনও সম্মান নাই।
যে কোনও ভাষার একটি আলাদা জগৎ থাকে। মানুষ ওই ভাষাটি শিখিয়া ওই জগতে প্রবেশ করে। সেই জগতের অন্য সদস্যদের সহিত আদানপ্রদান করে। এই আদানপ্রদানের যে মৌলিক নীতি ও ভিত্তি, তাহার অন্যতম হইল বানানবিধি। অর্থাৎ ইহা একটি সম্মেলক চুক্তি, ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি নহে। ভাষা একটি সম্মেলক সম্পদ, নিজের অন্দরমহলের আসবাব নহে। এই সম্মেলকের প্রতি দায়িত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধের জন্যই বানান শিক্ষা জরুরি। চ্যুতিকে অক্লান্ত ভাবে সংশোধন করা জরুরি। সর্বাঙ্গীণ ত্রুটিহীনতার দিকে এগোনোর চেষ্টা প্রশংসনীয়। যে ব্যবস্থা কম শ্রমের দ্বারা মহৎ নম্বর পাইবার পথ সুগম করিয়া দেয়, যে ব্যবস্থা বলে ভেজাল থাকিলে থাকুক, উৎকর্ষ লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই— তাহা নিজেকে খেলো করিতেছে, সমাজের অসম্মান করিতেছে। সভ্যতার ণত্বষত্ব বিপর্যস্ত করিতেছে।