গগনদীপ কং বলেছেন, সমস্ত তথ্য না পেলে তিনি অন্তত করোনার প্রতিষেধক নেবেন না। কে গগনদীপ কং? ভেলোর ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজে বর্তমানে কর্মরত এই অধ্যাপকের হাত ধরেই ভারতে এসেছিল রোটাভাইরাল ভ্যাকসিন। তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানী, যিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। এমন দিকপাল বিজ্ঞানী ভারতীয় প্রতিষেধকের বিরুদ্ধে সরব কেন? কারণ, ভারতে তৈরি প্রতিষেধকের কার্যকারিতার পক্ষে যথেষ্ট তথ্য নেই। তাঁর অভিযোগের প্রধান তিরটি ভারত বায়োটেক সংস্থার তৈরি ‘কোভ্যাক্সিন’-এর দিকে। ভারত বায়োটেক তাদের টিকা বাজারে ছাড়তে চায় তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মোড-এ। অর্থাৎ প্রয়োগ নয়, পরীক্ষার স্বার্থে। অধ্যাপক কং বলেছেন, তাঁর প্রতিষেধক সংক্রান্ত অভিজ্ঞতায় কস্মিন কালেও তিনি এমনটা শোনেননি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজি-র প্রাক্তন বিজ্ঞানী বিনীতা বলও প্রতিষেধক নিতে আগ্রহী নন। অভিযোগ একই। তথ্যের অভাব। প্রতিষেধক এসে গিয়েছে, এই আশায় যখন বুক বাঁধছে গোটা বিশ্ব, ভারতে বিতর্কের পারদ ক্রমশ চড়ছে।
পৃথিবী জুড়ে প্রয়োগের ছাড়পত্র পেয়েছে এখনও পর্যন্ত তিনটি প্রতিষেধক। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা, ফাইজ়ার-বায়োএনটেক ও মডার্না-র প্রতিষেধক। এর মধ্যে ভারতে ছাড়পত্র পেয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার ভ্যাকসিনেশন-এর প্রকরণ, যা পুণের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হচ্ছে। ভারতীয় নাম ‘কোভিশিল্ড’। ভারত বায়োটেকের তৈরি ‘কোভ্যাক্সিন’কে ‘স্ট্যান্ডবাই’ বা পরিবর্ত হিসেবে রাখা হবে। পরিবর্ত প্রয়োজন, কারণ সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রতিষেধক রফতানি হবে বহু দেশে, এ দিকে ভারতের নিজস্ব জনসংখ্যাই বিপুল। সংরক্ষণের অসুবিধের জন্য মডার্না ও ফাইজ়ারের প্রতিষেধক ভারতের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির মধ্যে লেগে গিয়েছে ব্যবসায়িক যুদ্ধ। সিরাম ইনস্টিটিউটের চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার আদার পুনাওয়ালার বক্তব্য, ভারতে একটাই ভ্যাকসিন— কোভিশিল্ড। বাকিদের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভারত বায়োটেক-এর চেয়ারম্যান কৃষ্ণ ইল্লার দাবি, কোভিশিল্ডে ব্যবহৃত হয়েছে অ্যাডিনোভাইরাল ভেক্টর। তাই শরীরের ইমিউন সিস্টেম করোনার প্রোটিনকে আলাদা করে চিনতে পারবে না। অভিযোগ গুরুতর। প্রতিষেধক তৈরির পদ্ধতিতেই আঘাত। এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক সারবত্তা রয়েছে? না কি শুধুই ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বার্থে বলা?
কোনও প্রতিষেধক কাজ করবে কি না, তা বলে দেবে দু’টো জিনিস: প্রতিষেধক তৈরির পদ্ধতি এবং ‘এফিকেসি ডেটা’, অর্থাৎ ট্রায়ালে সাফল্যের খতিয়ান। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যাকফুটে ভারত বায়োটেক। কিন্তু তাদের ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি নিয়ে তেমন সমালোচনা শোনা যায়নি। হায়দরাবাদের সংস্থাটি সার্স-কোভিড ভাইরাসের একটি স্ট্রেনকে অধিক তাপমাত্রা বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় করে প্রতিষেধক হিসেবে সরাসরি ব্যবহার করেছে। মূল ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় থাকায় শরীরে প্রবেশ করে ‘রেপ্লিকেট’ করতে— অর্থাৎ, সংখ্যায় বাড়তে— পারে না। কিন্তু ভাইরাল প্রোটিন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে জাগিয়ে তোলে।
মুশকিল হল, তাদের এফিকেসি ডেটার ভাঁড়ার শূন্য। ২০২০-র ১১ সেপ্টেম্বর তারা বাঁদরের দেহে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল করে। এই পরীক্ষা যথাযথ কি না, তা-ই প্রমাণিত নয়। কারণ, তাদেরই ওয়েবসাইট বলছে, গবেষণাপত্রটি তারা প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছে নেচার রিসার্চ জার্নাল-এ, যা এখনও বিবেচনাধীন। এফিকেসি ডেটা অনেক দূরের কথা। এ দিকে ইতিমধ্যেই সংস্থাটি গত ডিসেম্বরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে সাফল্য দেখিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় প্রতিষেধকটিকে বাজারে আনার কথা কল্পনাই করা যায় না। অর্থাৎ, গগনদীপ কংদের অভিযোগের সারবত্তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ডের পদ্ধতি সম্বন্ধে কৃষ্ণ ইল্লার অভিযোগ কি সত্যি? অক্সফোর্ডের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে একটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বা বাহক, যার মধ্যে পুরে দেওয়া রয়েছে করোনার ডিএনএ। শরীরে প্রবেশের পর অ্যাডিনোভাইরাস রেপ্লিকেট করতে পারবে না। স্পাইক প্রোটিনের ডিএনএ থেকে আরএনএ, অবশেষে স্পাইক প্রোটিন তৈরি হয়ে জাগিয়ে তুলবে ইমিউন সিস্টেমকে। তৈরি হবে অ্যান্টিবডি। তবে, অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে যে, শরীরে যে ভাইরাল প্রোটিনের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা, তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির পাশাপাশি খোদ অ্যাডিনোভাইরাল ভেক্টরটির বিরুদ্ধেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। ফলে আসল রোগের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা কমে দাঁড়ায় অর্ধেক। এই সমস্যা এড়ানোর জন্যই অবশ্য অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করেছেন। বিশ্ব জুড়ে মানুষের শরীরে শুধু এই বাহকের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির গড় সম্ভাবনা এক শতাংশ।
তা হলে, সিরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড, যা অক্সফোর্ডের পদ্ধতি মেনে তৈরি হয়েছে, তাতে কোনও পদ্ধতিগত ত্রুটি নেই। তবে, এফিকেসি ডেটা অন্য রকম বলছে।
গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথমে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের তথ্য প্রকাশ করে অক্সফোর্ড, যা নিয়ে তৈরি হয় চরম বিভ্রান্তি। দেখা যায়, একটি ডোজ়-এর সাফল্য ৬০ শতাংশের সামান্য বেশি। অন্য ডোজ়-এ সাফল্য ৯০ শতাংশ। এমনটা হওয়ার কারণ? অক্সফোর্ডের জেনার ইনস্টিটিউটেরই ইমিউনোলজিস্ট কেটি ইউয়ার জানান যে, সাফল্যের শতাংশের এই ওঠা-নামা দেখে মনে হচ্ছে, শরীরে করোনার স্পাইক প্রোটিন ও অ্যাডিনোভাইরাল ভেক্টর, দুইয়ের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। ২৩ নভেম্বর নেচার পত্রিকায় এই তথ্যবিভ্রান্তি নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হয়, যেখানে অক্সফোর্ডের ডোজ় নির্ণয়কে কটাক্ষ করেন জেমস উইলসন, যাঁর হাত ধরে নব্বইয়ের দশকে জিন-থেরাপিতে অ্যাডিনোভাইরাল ভেক্টরের প্রবেশ।
এখানেই শেষ নয়। ডোজ় নির্ণয় শুধরে নিয়ে ৮ ডিসেম্বর শেষ পর্যন্ত ল্যানসেট পত্রিকায় অক্সফোর্ডের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের সাফল্যের খতিয়ান ছাপা হয়। কিন্তু ছাপার আগে পত্রিকা থেকে চেয়ে পাঠানো হয় পরীক্ষার বয়সভিত্তিক তালিকা। দেখা যায়, ডোজ় শুধরানোর সময় যথেষ্ট সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক ব্যবহারই করা হয়নি, যাঁদের বয়স ৫৫ বা তার বেশি।
সিরাম ইনস্টিটিউট তাদের কোভিশিল্ড-এর এফিকেসি ডেটা হিসেবে দেখাচ্ছে ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র। কিন্তু এই পরীক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক বেছে নেওয়া হয়েছিল ব্রিটেন ও ব্রাজিল থেকে। নিয়মমাফিক সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড এই তথ্য সাফল্যের খতিয়ান হিসেবে দেখাতে পারে না। ভারতে তাদের নিজস্ব তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল করতে হবে। কারণ পরিবেশ, জেনেটিক গঠন, আগেকার অন্য ভ্যাকসিনের প্রভাব, অন্য রোগ, এবং বয়স নির্ধারণ করবে যে, শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাল ভেক্টরের প্রতি আলাদা করে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে কি না। হলে ভ্যাকসিন কাজ করবে ৬০ শতাংশের মতোই। ব্রিটেন ও ব্রাজিলে ব্যবহৃত ডোজ় ও ভারতের ডোজ়ও এক হবে না। সর্বোপরি, ভারতের অধিবাসীদের গড় বয়স যথেষ্ট কম। যে হেতু ল্যানসেট-এ প্রকাশের সময় ৫৫ বছরের বেশি স্বেচ্ছাসেবকের যথেষ্ট তথ্য নেই, তাই ভারতের তরুণ এবং বয়স্কদেরও প্রয়োজনীয় ডোজ় আলাদা করে নির্ণয় করা প্রয়োজন। ভারতে এই পরীক্ষা হয়নি; সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন (সিডিএসসিও)-এর দফতরে সিরাম ইনস্টিটিউটের এই তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের তথ্য জমা পড়েনি। অর্থাৎ অক্সফোর্ডের প্রতিষেধকের সাফল্য যা-ই হোক, সিরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড-এর এফিকেসি ডেটার ভাঁড়ারও ভারত বায়োটেক-এর মতোই শূন্য।
এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, অতিমারি রুখতে প্রতিষেধক প্রস্তুতকারকদের আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল। তবে, এক বার ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে প্রয়োগ করা হলেও আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। সাধারণত তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের নামে প্রতিষেধককে কখনও খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয় না। এ বারটা দৃশ্যতই ব্যতিক্রমী। আজ থেকে প্রতিষেধক প্রদানের প্রথম পর্ব শুরু হচ্ছে। সব প্রশ্ন ছাপিয়ে আশা রইল, প্রতিষেধক সব সঙ্কট-অন্ধকার দূর করতে সাহায্য করবে।