খোলা আকাশের নীচে নাটক হচ্ছিল, ‘নাট্যআনন’-এর যুগনায়ক। কিছু মানুষ চেয়ারে বসে, অনেকে দাঁড়িয়েই। আর কাছেই বাগানে কাজ করছিলেন কয়েক জন শ্রমিক, মাটি-সিমেন্ট নিয়ে হাত চালাতে চালাতে দেখছিলেন তাঁরাও। মঞ্চে যখন বিবেকানন্দ ফুঁসে উঠে বলছেন, বেদ-মহাভারত পড়ো, কিন্তু মানুষের থেকে মুখ ফেরানো শাস্ত্রকে ছুড়ে ফেলে দাও— ওঁদের এক জন অস্ফুটে বললেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, ওঁরা দাঁড়িয়ে পড়ছেন ‘নতুন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে-মালা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে...’ শুনতে শুনতে। ‘থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়’ বলেছিলেন রামকৃষ্ণ— সাক্ষাৎ প্রমাণ। আরও যা মনে হচ্ছিল: বিবেকানন্দ-বেশী এক অভিনেতাই যদি সটান লোক দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন, আসল মানুষটা না জানি কী পারতেন!
কী পেরেছিলেন, লেখা আছে ইতিহাসেই। নইলে মনীষীময় এই ভারতে এক সন্ন্যাসীর জন্মদিন কখনও একটা দেশের যুব দিবস হয়ে উঠতে পারত না। স্কুলে এক শিক্ষক সকৌতুক বলেছিলেন, খেয়াল করে দেখবি, রামকৃষ্ণের নামে সবচেয়ে বেশি ফার্মেসি, আর বিবেকানন্দের নামে ক্লাব। মানে নিরাময় পেতে ঠাকুর, আর কাজ করতে স্বামীজি ভরসা! এক পশ্চিমবঙ্গেই বিবেকানন্দের নামে কত ক্লাব আছে, সমীক্ষার বিষয় হতে পারে।
এক সন্ন্যাসী যুবনায়কের মর্যাদা পাচ্ছেন, অদ্ভুত না? তারুণ্যের রং স্বভাবত গৈরিক নয়, চার পাশের ধরাছোঁয়ার বিচিত্র বর্ণিল জগৎ নিয়ে যার কারবার, সে এক সন্ন্যাসীর কথা শুনতে যাবে কেন? কিন্তু শুনল, কারণ সন্ন্যাসীর মধ্যে এমন তেজ সে আগে দেখেনি। ‘তেজ’ শব্দটাই তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মেলে। উনিশ শতকের বাংলা বিদ্যা-বুদ্ধির প্রতিমূর্তি দেখেছে বহু মনীষীর মধ্যে। কিন্তু বাইরের শাসকের ছড়ি ঘোরানো আর ভিতরের জাতপাত-আচারবিচারের ধাক্কা এত প্রবল ছিল, তার সঙ্গে লড়াইয়ে শুধু ‘ইনটেলেক্ট’ ছিল কমজোরি। দরকার ছিল এমন এক মন, যা নিজে জ্বলে ওঠার পাশাপাশি জ্বালিয়েও দিতে পারে। যার প্রজ্ঞা সমাজ-সংসারের ঊর্ধ্বে ধ্যানমগ্ন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকে না, তেজি কর্মময়তায় নেমে আসে মানুষের মধ্যে। এই তেজ আবেগ-থরথর, আবার একই সঙ্গে যুক্তি-প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নকাতর। এই তেজ বলে: তোমাকে খুব ভালবাসি, আর ভালবাসি বলেই তোমার প্রতিটি দোষ, প্রতিটা স্খলন ঠিক করার জন্য আমি প্রশ্ন তুলব। তারুণ্যের তেজও এ রকম— এই ভালবাসায় হাত বোলাচ্ছে তো পরক্ষণেই সেই হাতের উদ্যত তর্জনীতে প্রশ্ন শানাচ্ছে। সন্ন্যাসী হয়েও প্রেমে ও প্রশ্নে সমান যাপনই বিবেকানন্দকে তারুণ্যের কাছের মানুষ করে তুলেছে।
আদর্শ, আইকন তো অনেক বড় ব্যাপার। মানুষের জন্য এক সন্ন্যাসীর যে অসম্ভব ভালবাসা, তার নমুনা তাঁর সমকালে বিরল। নাটকে এক মা অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে আসেন বিবেকানন্দের কাছে, সাধুর স্পর্শে যদি সে সুস্থ হয়। রোগ নিরাময়ের অলৌকিক ক্ষমতা তাঁর নেই, এই বাক্যে মায়ের মন ভুলবে কেন। বরং নারীটি সন্দিহান, ভিন্-ধর্মী, পতিতা বলেই নিশ্চয় সন্ন্যাসীর কাছে অস্পৃশ্য সে। কান্না-থরথর বিবেকানন্দ শেষে মেয়েটির মাথায় হাত রাখেন, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলেন তিনি রোগ সারাতে পারেন না, বরং তিনি নিজে যে অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন তার ওষুধ পেলে সে যেন একটু দিয়ে যায়। এ ঘটনা বাস্তবে হয়েছিল কি না তা জানা তত জরুরি নয়, যতটা জরুরি শিক্ষা অন্ন স্বাস্থ্য-সহ জীবনের সমস্ত অধিকারবঞ্চিত যে মানুষ বিশ্বাসে ভর করে ধর্মের আশ্রয়ে আকুল ছুটে আসেন, সেই সরল অসহায় নিরুপায় মানুষের প্রতি তাঁর বুদ্ধোপম করুণা। বিশ্ববিজয় করে দেশে ফেরার পর এক দিন সশিষ্য খুব শাস্ত্রচর্চা হচ্ছে, গিরিশ ঘোষ এসে বললেন, ‘বেদবেদান্ত তো ঢের পড়লে, এই যে দেশে ঘোর হাহাকার, অন্নাভাব... এর উপায় তোমার বেদে কিছু বলেছে?... এককালে যার বাড়িতে রোজ পঞ্চাশখানি পাতা পড়ত, সে আজ তিন দিন হাঁড়ি চাপায়নি— এ সকল রহিত করবার কোন উপায় বেদে আছে কি?’ নির্বাক বিবেকানন্দের চোখে জল, উঠে চলে যেতে গিরিশচন্দ্র বলেছিলেন, “তোর স্বামীজীকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না; কিন্তু ঐ যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি।” একদা গুরুভাইকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের তথাকথিত ধর্মের কিছুই বুঝি না... কিন্তু আমি অপরের ব্যথা বোধ করতে শিখেছি।’ বিবেকানন্দের উত্তরাধিকার সহমানুষের যন্ত্রণায় দ্রব এমন হৃদয়বত্তার উত্তরাধিকার।
আর তাঁর কথা? ছুরির ফলার মতো, মর্মে আমূল বিঁধে যায়। স্কুলবেলায় হস্টেলে ছেলেদের দৌরাত্ম্যে নাস্তানাবুদ এক সন্ন্যাসী তাঁর সহকর্মীকে কাতর ভাবে বলেছিলেন, কী করব, আমি যে স্বামীজির মতো গালাগালি দিতে পারি না! অনন্ত সোহাগের গায়ে গায়েই তাঁর অকরুণ শাসন— সত্যের, পরিত্রাতার ভেকধারী যে কোনও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। জাহাজে ভারত ও ভারতীয়ত্বের প্রতি সাহেবি অবজ্ঞার জবাব তাঁর কাছে সাহেবের কলার চেপে সাগরে ছুড়ে দেওয়ার স্পর্ধিত বিক্রমে। আবার ব্রাহ্মণ্যবাদী, শোষক ভারতকে তিনি যে ভাষায় চ্যালেঞ্জ ছোড়েন, তাতে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখের ও মনের ভাব কী হত, অতীতরথে ফিরে গিয়ে দেখার ইচ্ছে জাগে।
তিনি আদ্যন্ত নো-ননসেন্স এক মানুষ, শাস্ত্রজ্ঞ কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল, তাঁর কাছে ধর্মের বহিরঙ্গের গুরুত্ব নেই। তিনি আমেরিকায় মুখের উপর বলতে পারেন, ভারতের অন্তর-ঐতিহ্য ঢের আছে কিন্তু বাইরেটা দীনহীন, তাই তোমাদের কাছ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিটুকুই যা দরকার, তোমরা বরং মনের শান্তি পেতে প্রাচ্যের কাছে বাবু হয়ে বসো। আর ঘরে ফিরে সেই আমেরিকারই ব্যক্তি-স্বাধীনতার, কর্মময়তার তুমুল প্রশংসা করে এ দেশের ঘণ্টা-নাড়া, ছুতমার্গসর্বস্ব বকধার্মিকদের দরজা দেখিয়ে বলেন বিদেয় হও, ধুলোয় মিশে যাও, এখন নতুন ভারতের, নতুন জেগে-ওঠার পালা। বক্তৃতার পর বক্তৃতায়, চিঠির পর চিঠিতে বিবেকানন্দের ভাব ও ভাষার বিস্ফারে স্তম্ভিত হতে হয়, দুঁদে রাজনীতিক বা সমাজ সংস্কারক নন, এই কথা বলছেন এক সন্ন্যাসী!
বোধ আর বুদ্ধিকে আমরা কথায় কথায় এক সঙ্গে জুড়ে বলি বটে, কিন্তু আমাদের জীবনে ও-দুটো মেলে না। আমরা কেবল বুদ্ধির ভক্ত, বোধ অর্জনের আয়াস আমাদের নেই। যাঁরা সে বোধে উত্তীর্ণ, তাঁদের কথা চুপ করে, মন পেতে শোনা যায় অন্তত। যেমন শুনছিলেন ওঁরা সে দিন, নাটকের মঞ্চে বিবেকানন্দের কত কথা— প্রেমে টলটল, প্রশ্নে জ্বলজ্বল। হাতের কাজ পড়ে থাকছিল হাতে। পরমুহূর্তেই তেতে উঠছিল চতুর্গুণ আত্মবিশ্বাসে!