যোগী আদিত্যনাথ। পিটিআই।
একদা এই ভারতে রাজসভায় দাঁড়াইয়া এক সন্ন্যাসিনী রাজাকে বলিয়াছিলেন, তিনি বৃথাগর্বী। রাজর্ষি জনক মুক্তপুরুষ হইবার আস্ফালন করিলেও বস্তুত তিনি গৃহীও নহেন, মুক্তও নহেন। সুলভার তিরস্কার নীরবে শুনিয়াছিলেন জনক। ইহা মহাভারতের কাহিনি। আজ উত্তরপ্রদেশের শাসক স্বয়ং এক সন্ন্যাসী— এ ঘোর কলিতে সন্ন্যাসী যাহা হইয়াছেন। যোগী আদিত্যনাথ বসন রাঙাইয়াছেন, মনও বোধ হয় রাঙাইয়াছেন, তবে নিজস্ব রঙে। তিনি নিজের বিরুদ্ধে একটি বঙ্কিম ‘টুইট’ও সহ্য করিতে রাজি নহেন। সমাজমাধ্যমে তাঁহার প্রতি কটাক্ষ করিবার অপরাধে সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়াকে গ্রেফতার করিয়াছিল পুলিশ। অবশেষে শীর্ষ আদালতকে মনে করাইতে হইল, ইহা অসাংবিধানিক। নাগরিক মুখ্যমন্ত্রীর মানহানি করিয়াছে কি না, তাহার বিচার চলিতে পারে। কিন্তু সমাজমাধ্যমে শাসকের সমালোচনা গুরুতর অপরাধ নহে। তাহার জন্য বিনা জামিনে কারাবাস কেন? ব্যক্তিস্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয়, মনে করাইয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। দেশবাসী অন্তত কিছুটা আশ্বস্ত হইবে। সমাজমাধ্যমে সামান্য পরিহাস দেখিলেও রাজপেয়াদা পাঠাইতেছেন শাসকরা। হাজতবাস, চাকরি হইতে বরখাস্ত, সামাজিক হেনস্থা, কিছুই বাকি নাই। অপর পক্ষে, যে সঙ্ঘ-অনুগামীরা অশ্লীল, হিংস্র বাক্যে সমাজমাধ্যমে বিরোধীদের অবিরাম বিদ্ধ করিতেছেন, সেই ‘ট্রোল’ বাহিনী সুরক্ষিত রহিয়াছে।
সমালোচকের প্রতি শাসকের অতি-সক্রিয়তা, সমর্থকের প্রতি নিষ্ক্রিয়তা ভয়ানক বার্তা বহন করে। উত্তরপ্রদেশের রেলপুলিশ এক সাংবাদিককে প্রচণ্ড প্রহার করিয়া গ্রেফতার করিয়াছে, হাজতেও তাঁহার প্রতি অমানবিক আচরণের অভিযোগ। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে এক সাংবাদিক জামিনে মুক্তি না-পাইতে বন্দি হইলেন আর এক সাংবাদিক। সাংবাদিক বা নাগরিকের কথার সত্যাসত্য আর বিবেচনার বিষয় নাই। মুখ খুলিয়াছেন, ছবি তুলিয়াছেন, ইহাই ফৌজদারি অপরাধ বলিয়া গণ্য হইতেছে। ২০১২ সালে তামিলনাড়ুতে কার্তি চিদম্বরমের সম্পদবৃদ্ধি লইয়া টুইট করিয়া জেলে গিয়াছিলেন এক ব্যক্তি। বাল ঠাকরের মৃত্যুতে মুম্বই অচল হইবার সমালোচনা করিলে গ্রেফতার হইয়াছিলেন দুই ছাত্রী। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে পরিহাস করিয়া টুইট করিবার জন্য অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের গ্রেফতার হইবার কথা কাহারও অবিদিত নাই। সম্প্রতি এ রাজ্যের এক বিজেপি কর্মীও গ্রেফতার হইয়াছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করিয়া। এই মামলাগুলি আদালতে দাঁড়াইতে পারে না। অম্বিকেশ মহাপাত্রকে ক্ষতিপূরণ দিবার নির্দেশ দিয়াছিল মানবাধিকার কমিশন এবং কলিকাতা হাই কোর্ট। কিন্তু গত পাঁচ বৎসরে নরেন্দ্র মোদী-সহ বিভিন্ন ক্ষমতাসীন নেতা যে ভাবে সমাজমাধ্যমে সমালোচকদের প্রতি খড়্গহস্ত হইয়াছেন, কখনও মানহানি, কখনও অশান্তি উস্কাইবার মামলা ঠুকিয়াছেন, তাহা কেবল অসহিষ্ণুতার প্রকাশ নহে। এত দিনে স্পষ্ট যে, তাঁহারা কয়েক জনকে ভয় দেখাইয়া সকল বিরোধীর কণ্ঠকে নীরব করিতে চাহেন। বাক্স্বাধীনতা রুখিতে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োগ, গণতন্ত্রে ইহার অধিক ভয়ানক কী হইতে পারে?
শীর্ষ আদালত তাই উত্তরপ্রদেশ সরকারকে রাজধর্ম মনে করাইয়াছে। বলিয়াছে, ‘মহানুভবতা প্রদর্শন করো।’ যাহার বক্তব্য সমর্থনের যোগ্য নহে, তাহার প্রতিও সরকার নিষ্ঠুর, প্রতিশোধকামী হইতে পারে না। আদালতের এই সতর্কবার্তাকে স্বাগত। সমালোচককে হাজতে পুরিয়া বিরোধীদের নিকট ‘দৃষ্টান্ত’ সৃষ্টি করিবার সরকারি অপচেষ্টা অতঃপর কিছু কমিতে পারে। স্পষ্টবাদী নাগরিকের জামিন পাইবার সম্ভাবনাও হয়তো কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পাইল। তবে আদালতের বার্তা হৃদয়ঙ্গম করিয়া শাসক উদার হইবে, রাজধর্ম পালন করিবে, এ ঘোর কলিতে এমন আশায় বুক বাঁধিতে ভরসা হয় না।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।