ছবি: রয়টার্স।
হংকংয়ের সরকারি গ্রন্থাগারগুলিতে কিছু গ্রন্থ সাধারণ পাঠকের নাগাল হইতে সরাইয়া লওয়া হইয়াছে। সেইগুলি ‘কর্তৃপক্ষ’ যাচাই করিয়া দেখিতেছেন। কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ শাসক। শাসক, অর্থাৎ চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’র ছদ্মসজ্জা গত কয়েক বছর ধরিয়াই দ্রুত খসিয়া পড়িতেছে, ভূতপূর্ব ব্রিটিশ উপনিবেশটির স্বশাসনের সমস্ত দাবি নস্যাৎ করিয়া বেজিংয়ের শাসকরা হংকংকে সম্পূর্ণ গ্রাস করিতে বদ্ধপরিকর। সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতেই সম্প্রতি জারি হইয়াছে নূতন নিরাপত্তা আইন। এই আইন এক ধাক্কায় হংকংকে ‘এক দেশ, এক ব্যবস্থা’র নূতন যুগের পথে অনেকখানি আগাইয়া দিয়াছে। স্বৈরশাসনের ফাঁস অতঃপর আরও জোরদার হইবে। সেই ফাঁস, যথারীতি, সহস্রমুখী— নানা ভাবে স্বাধীনতার দাবি এবং প্রতিবাদী আচরণ দমন করাই তাহার বহুমাত্রিক লক্ষ্য। স্বৈরতন্ত্রের স্বভাব মাফিক একটি প্রধান লক্ষ্য: বই। এমন বই, যাহা শাসকের পছন্দসই নয়। এমন বই, যাহাতে স্বাধীনতার কথা বলা হইয়াছে, যে বই পড়িলে মানুষ অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকারের দাবিতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারে। অতএব, কর্তারা যাচাই করিতে বসিয়াছেন, কোন কোন বই নূতন আইনের পরিপন্থী। প্রথম দফায় অন্তত নয়খানি বই তাঁহাদের ছাঁকনিতে পাঠানো হইয়াছে। অনুমান করা যায়, ছাঁকনির সংখ্যা ও আয়তন উত্তরোত্তর বাড়িবে। এক দিকে, বইয়ের পাশাপাশি যাচাই করা হইবে বিবিধ পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য পরিসরে প্রকাশিত লেখা এবং ছবি। অন্য দিকে, শাসকের শ্যেনদৃষ্টি সরকারি গ্রন্থাগারেই সীমিত থাকিবে, এমন ভরসা কিছুমাত্র নাই।
ভরসার কোনও কারণও নাই। হংকংয়ের গণতন্ত্রকামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা জোশুয়া ওয়ং মন্তব্য করিয়াছেন, চিনের মূল ভূখণ্ডে যে সেন্সর ব্যবস্থা প্রচলিত, হংকংয়েও তাহাই প্রবর্তন করিতে চাহিতেছেন শাসকরা। চিনা কমিউনিস্ট পার্টি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনে বদ্ধপরিকর। বস্তুত, গত সাত দশকে সেই দেশে নানা ক্ষেত্রে, বিশেষত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচালনায়, বহু পরিবর্তন ঘটিয়াছে, নানা সংস্কার সাধিত হইয়াছে, কিন্তু বহুমতের প্রকাশকে কখনও কোনও ভাবে মানিয়া লওয়া হয় নাই। গত শতাব্দীর ‘সমাজতান্ত্রিক’ দুনিয়ার অভিজ্ঞতা এই বিষয়ে কার্যত এক ছাঁচে ঢালা। বস্তুত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের এই চণ্ডনীতি যে কোনও স্বৈরশাসনের ধর্ম। কিন্তু গভীর উদ্বেগের কারণ ইহাই যে, ক্রমশ আপাত-গণতন্ত্রের পরিসরেও এই আচরণ প্রকট হইতেছে। দুনিয়া জুড়িয়া ভিন্নমত-অসহিষ্ণু শাসকের ভয়ানক মূর্তি উত্তরোত্তর আরও ভয়ানক হইতেছে। ঘরে ও বাহিরে, কাছে এবং দূরে— অনেক নির্বাচিত শাসকই কেবল সমালোচনা শুনিতেই নারাজ নহেন, কেহ কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলিলেও তাঁহাদের ক্রোধ জাগ্রত হয়, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি উত্তেজিত হয়। ইহাদের দেখিয়া বাংলা গানের নাগরিক কবিয়ালের কথায় বলা চলে— শাসক যে-রঙেরই হোক, ভয়ানক। বস্তুত, বহু ‘গণতান্ত্রিক’ দেশেই রাষ্ট্রযন্ত্রীরা আজ আর সেন্সর ইত্যাদি প্রয়োগের দায়টুকুও স্বীকার করেন না, সরাসরি নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষার ধুয়া তুলিয়া মতামত দমন করেন, বইপত্র নিষিদ্ধ করেন, এমনকি তাঁহাদের অ-পছন্দের বই বা পত্রপত্রিকা রাখিবার দায়ে নাগরিককে গ্রেফতার হইতে হয়। এই শাসকদের কীর্তি দেখিলে হীরকরাজও জিভ কাটিতেন।