ছবি: সংগৃহীত
আরও একটি বিতর্কিত প্রশাসনিক সংস্কার। কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত করিল, অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড উঠাইয়া দেওয়া হইতেছে। কেহ বলিতেই পারেন, ভারত যখন সর্বশক্তিতে শিল্পোন্নত দেশ হইতে চাহিতেছে, তখন প্রাগৈতিহাসিক হস্তচালিত তাঁতের স্থান কোথায়? স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক, তর্কটি আজিকার নহে। এই তর্কের বয়স আট দশকের অধিক। ১৯৩৮ সালে, জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে, ভারতে যখন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গঠিত হইয়াছিল, তখনই প্রশ্ন উঠিয়াছিল— জাতীয়তাবাদী নেতারা যে শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখিতেছেন, তাহাতে কি খাদির ঠাঁই হওয়া সম্ভব? ভারতীয় রাজনীতিতে তখনও মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর নৈতিক আধিপত্য প্রশ্নাতীত, প্রশ্নটি তবুও উঠিয়াছিল। তাহার উত্তরে জাতীয়তাবাদী নেতারা বলিয়াছিলেন, ইহা সত্য যে শিল্পায়নের ছন্দের সহিত খাদি পা মিলাইতে পারিবে না, কিন্তু তবুও তাহাকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে রাখিতে হইবে। কারণ, ইহা শুধু শিল্প, উৎপাদন বা অর্থনীতির প্রশ্ন নহে; হস্তচালিত তাঁতের গুরুত্ব অন্যত্র। প্রকৃতই হস্তচালিত তাঁতে ভারতের আত্মা বিরাজ করে। স্বাধীন ভারতে যোজনা কমিশন যখন মধ্যগগনে, সেই আমলেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড— রাষ্ট্রীয় শিল্পযজ্ঞে যাহাতে শ্রমনিবিড়, গ্রামীণ ক্ষেত্রটি বাদ না পড়িয়া যায়, তাহা নিশ্চিত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। সেই বোর্ডটির বিলুপ্তির সিদ্ধান্তকে, অতএব, এই প্রেক্ষিতেই দেখা বিধেয়।
ভারতে এখনও কত মানুষ জীবিকা হিসাবে হস্তচালিত তাঁতের উপর নির্ভরশীল, সেই হিসাব সরকারের নিকট থাকিবারই কথা। হ্যান্ডলুম বোর্ডের প্রধানতম দায়িত্ব ছিল এই মানুষগুলির স্বার্থরক্ষা করা, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাঁহাদের প্রতিনিধিত্ব করা। বোর্ডটির বিলুপ্তির অর্থ, অতঃপর তাঁহাদের বাজারের উপর নির্ভর করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে বাজার বিপজ্জনক, কারণ সেই সমুদ্রে ভাসিবার শক্তি হস্তচালিত তাঁত নামক ডিঙিটির নাই। এইখানেই সরকারের দায়িত্ব। কেহ বলিতে পারেন, আরও পাঁচটি শ্রমনিবিড় ক্ষেত্র যেমন ভাবে কালের গতিতে হারাইয়া গিয়াছে, হস্তচালিত তাঁতও যদি তেমন হারাইয়া যায়, তাহাতে ক্ষতি কী? ক্ষতি এইখানেই যে, খাদিতে ভারতের আত্মা বিরাজ করে। তাহাতে ভর করিয়া ভারতের জাতীয়তাবাদ সর্বজনীন হইয়াছিল। সুতরাং, হস্তচালিত তাঁতকে বাজার বা অর্থনীতির মানদণ্ডে নহে, বিচার করিতে হইবে তাহার ঐতিহাসিক গুরুত্বের মাপকাঠিতে। ভাবিতে হইবে, এমন আর কিছু কি আছে, যাহা ভারতের গত একশত বৎসরের ইতিহাসকে এই ভাবে শরীরে ধারণ করিতে পারে? ইহাকে রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য। ন্যূনতম সরকারের যুক্তিতে সেই দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলা চলে না।
সেই জাতীয়তাবাদী, অতএব কংগ্রেস-গন্ধী অতীতে, নরেন্দ্র মোদীদের রুচি না-ই থাকিতে পারে। তাহা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সেই দুর্ভাগ্যকে ভারত মানিয়া লইয়াছে। এক্ষণে প্রশ্ন, হস্তচালিত তাঁত কি কেবল অতীত? তাহার কি ভবিষ্যৎ নাই? বিশ্ব বাজারে ভারত নিজের যে পরিচিতি তৈরি করিতে উদ্গ্রীব, তাহাতেও তাঁত গুরুত্বপূর্ণ। যে কয়টি পণ্যের গায়ে ভারতীয়ত্বের নির্ভুল ছাপ আছে, এবং বিশ্ববাজারে যাহার চাহিদা আছে, তাঁতজাত বস্ত্র তাহার মধ্যে অন্যতম। তাহার যথাযথ বিপণন করিলে সেই বাজার আরও বিস্তৃত হইতে পারে, মূল্যশৃঙ্খলেও এই পণ্যটি উচ্চতর ধাপে পৌঁছাইতে পারে। তাহাতে কর্মসংস্থান হইবে, বিশ্ব-অর্থনীতির সহিত গ্রামীণ ভারতের যোগসূত্রটিও দৃঢ়তর হইবে। ইহাই তো উন্নয়নের পথ। এবং, নরেন্দ্র মোদীরা আশ্বস্ত হইতে পারেন, এই বিপণনের কথা নেহরুও ভাবেন নাই। প্রয়োজন শুধু বিবেচনাবোধের। তাঁতের আসন যে ভারতাত্মায় পাতা, তাহা স্বীকার করিবার।