লোকাল ট্রেন হইতে বাজার, কলকারখানা হইতে সিনেমা হল, সবই চালু হইয়া গেল, স্কুলগুলি আর কত দিন বন্ধ থাকিবে?’ হাওয়ায় কান পাতিলেই এই প্রশ্নটি শোনা যাইতেছে। কার্যত একটি গোটা শিক্ষাবর্ষ জুড়িয়াই বন্ধ থাকিল স্কুলগুলি। তাহাতে প্রবল ক্ষতি, এবং সেই ক্ষতি চরিত্রে অসম। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছাইয়া থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। তাহাদের অনেকেরই বাড়িতে স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ নাই; ইন্টারনেট সংযোগ নাই, পড়া দেখাইয়া দিবার মতো অভিভাবকও নাই। এই এক বৎসর তাহাদের অনেককেই স্কুলছুটের দলে ঢুকাইয়া দিল। কেহ কাজে লাগিয়া পড়িল, কাহারও বা বিবাহ হইয়া গেল। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই ক্ষতি ভয়ঙ্কর। স্কুল বন্ধ থাকিবার কারণে শুধু যে এই ছেলেমেয়েগুলির লেখাপড়ার পাট মাঝপথেই চুকিয়া গেল, তাহাই নহে— ইহাতে তাহাদের ভবিষ্যৎ আয়-সম্ভাবনা, জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, সন্তানের ভবিষ্যৎ, সবের উপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়িবে। স্কুলে এক বৎসর অতিরিক্ত পাঠের সহিত জীবনযাত্রার এই সূচকগুলির সম্পর্ক গভীর ও অঙ্গাঙ্গি। এবং, তাহা সামাজিক অসাম্য আরও বাড়াইয়া তুলিবে। স্কুল খুলিবার যে দাবি শোনা যাইতেছে, তাহাকে এই পটভূমিকায় দেখাই বিধেয়।
কিন্তু, তাহার পরও দাবিটি কি এখনই মানিয়া লওয়া যায়? অন্য সব পরিসরের সহিত স্কুলের প্রধানতম পার্থক্য, তাহা মূলত অপ্রাপ্তবয়স্কদের পরিসর। ভবিষ্যতের সেই নাগরিকদের নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর বর্তায়। ফলে, স্কুলগুলিকে আলাদা ভাবে দেখা, এবং শিশুদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে না। প্রশ্ন হইল, স্কুল বন্ধ থাকিলেই কি ছেলেমেয়েদের মারণ ভাইরাস হইতে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? সব পরিসরই খুলিয়া যাওয়ায়, ছেলেমেয়েরা যদি বাড়ির বাহির না-ও বা হয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাই কি তাহাদের জন্য রোগ বহন করিয়া আনিতে পারে না? কথাটি ভুল নহে, কিন্তু অর্ধসত্য। দুইটি কারণে। প্রথমটি রাশিবিজ্ঞানের যুক্তি— যত বেশি লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইবে, সংক্রমণের সম্ভাবনাও ততই বাড়িবে। দ্বিতীয় যুক্তিটি মনস্তত্ত্বের— বাড়িতে সন্তান বা প্রিয়জন আছে জানিলে মানুষ যতখানি সতর্ক হইয়া চলেন, সমষ্টির প্রতি ততখানি দায়বদ্ধতা অধিকাংশ লোকই দেখান না। স্কুল সেই সমষ্টির পরিসর, ফলে তাহার বিপদ কখনও বাড়ির সহিত তুলনীয় হইতে পারে না। গোটা দুনিয়ার, ভারতেরও, অভিজ্ঞতা দেখাইয়াছে যে, স্কুল খুলিলেই কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়িয়া যায়। বহু জায়গায় স্কুল খুলিয়া ফের বন্ধ করিতে হইয়াছে। ইহা সমাপতন নহে।
এই অবস্থায় স্কুল খোলা না-খোলার সিদ্ধান্তটি অতি জটিল। কে সিদ্ধান্ত করিবে— স্কুল কর্তৃপক্ষ, বোর্ড, না রাজ্য সরকার? কলিকাতার বেশ কিছু স্কুল জানাইয়াছে, অভিভাবকদের সম্মতি না মিলিলে স্কুল খোলা যাইবে না। তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান, কিন্তু তাহাতেও কি সামাজিক ভাবে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য বিকল্পে পৌঁছানো সম্ভব? স্কুল বন্ধ থাকায় যে ছাত্ররা সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে, এবং স্কুল খোলা বিষয়ে যে অভিভাবকদের মতামত গুরুত্ব পাইবে, তাঁহারা কি একই স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করিবেন? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজিতে হইবে। কিন্তু আজ না হউক পরশুর পরের দিন স্কুল খুলিতেই হইবে। তাহার জন্য যে বিশেষ প্রস্তুতি প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোনও সংশয় নাই। বিভিন্ন দফায় ক্লাস করানো, স্কুলের পরিকাঠামো গড়িয়া তোলা, নিয়মিত স্যানিটাইজ়েশনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি অপরিহার্য। সরকারের প্রধান কর্তব্য এই প্রস্তুতিপর্বটিকে নিখুঁত করা। স্কুলের পরিসরটিকে যত দূর সম্ভব নিরাপদ করিয়া তবেই ছেলেমেয়েদের আসিতে বলা বিধেয়।