এনআরসির ফুল ফর্ম বলো! হোয়াট ইজ় দ্য ফুল ফর্ম অব এনআরসি? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সুরেই প্রশ্নটা ছুড়ছিলেন। একই দিনে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকেও উঠছে সেই একই প্রসঙ্গ— এনআরসি।
বিজেপি নেতারা লাগাতার বলে চলেছেন, অসমের মতো বাংলাতেও এনআরসি হবে। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে মানুষের মনে। রোদ মাথায় করে ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর খবরও মিলছে রাজ্যের জেলা থেকে।
কিন্তু কী ভাবে হবে এনআরসি?
যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা বাবুল সুপ্রিয়কে প্রশ্নটা করার সুযোগ পাননি। সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে দিল্লিতে এক আলাপনে সামনে পেয়ে প্রশ্নটা করা গেল। অসমে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ওরফে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস’ তৈরি হয়েছে। তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রয়েছে। অসম চুক্তিতেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বাংলায় এনআরসি কী ভাবে হবে? দিলীপের উত্তর ছিল, আগে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করা হবে। তার পরেই এনআরসি।
প্রথম মোদী সরকারের জমানায় যে সব কাজ চেষ্টা করলেও কেন্দ্র সংসদে করে উঠতে পারেনি, তার মধ্যে অন্যতম এই ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কাজ। সংসদে বিল পেশ হয়েছিল ২০১৬-তেই। প্রায় আড়াই বছর ধরে সংসদীয় যৌথ কমিটিতে চুলচেরা বিচার হয়। ২০১৯-এর জানুয়ারিতে লোকসভায় বিল পাশও হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্যসভায় বিল পাশ হয়নি। লোকসভার মেয়াদ ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিলেরও পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটে।
নতুন করে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এসেই তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ আইন তৈরির মতো প্রথম পাঁচ বছরের অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত সেরে ফেলেছে। এখন লোকসভার সঙ্গে রাজ্যসভাতেও মোদী সরকারের সংখ্যার জোর রয়েছে। কোনও বাধা নেই। তা সত্ত্বেও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল নিয়ে সরকার তাড়াহুড়ো করেনি। সঙ্ঘ-পরিবার দাবি তুললেও নয়। তুরুপের তাস কি আরও কিছু দিন আস্তিনে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছে?
সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে দেখা যাক কী রয়েছে ওই বিলে? মাত্র তিন পৃষ্ঠার এই বিলের মোদ্দা কথা একটাই। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন। অনুচ্চারিত থাকলেও দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যে কোনও সরকারি বিলেই তার উদ্দেশ্য ও কার্যকারণ বলা থাকে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল এ বিষয়ে নীরব। বিলে ‘স্টেটমেন্ট অব অবজেক্টস অ্যান্ড রিজ়ন্স’ নেই। অর্থাৎ কেন এই বিল আনা হচ্ছে, কেন আইনে সংশোধন দরকার, তার ব্যাখ্যা নেই। সংসদীয় কমিটির সামনেও সরকার এ প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
বিলে বলা না হলেও, বিজেপি নেতারা বলছেন, এর উদ্দেশ্য হল স্বাধীনতা ও দেশভাগের যে লক্ষ্য অপূর্ণ থেকে গিয়েছে, তা পূরণ করে ফেলা। বিজেপি নেতৃত্বের যুক্তি স্পষ্ট। ধর্মের ভিত্তিতে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই তো দেশ ভাগ হয়েছিল! হিন্দুদের জন্য ভারত। মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। হিন্দুরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে চলে এলে এ দেশে শরণার্থীর স্থান পাবেন। পবিত্র হিন্দু-স্থান গড়ে উঠবে। আর এ দেশের মুসলমানরা? বিনায়ক দামোদর সাভারকরের লেখা ক্ষুদ্র পুস্তিকা ‘হিন্দুত্ব’ থেকেই সঙ্ঘ-পরিবারের একধর্মাবলম্বী রাজনীতির জন্ম। সেই রাজনীতিরই আর এক ফসল দ্বিজাতিতত্ত্ব। এই তত্ত্ব লুফে নিয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। পরিণাম— দেশভাগ। আরএসএস-বিজেপি এ বার সেই দেশভাগের লক্ষ্য পূরণ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত মুসলিমদের কী হবে? দিলীপবাবুরা বলছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে আটক করা হবে। তার পর ফেরত পাঠানো হবে। সেই জন্যই এনআরসি।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিলে বা সিটিজ়েনশিপ বিলে অবশ্য কোথাও গোটা দেশে এনআরসির কথা বলা নেই। এ দেশে কেউ বেআইনি ভাবে ঢুকলে, বৈধ অনুমতি নিয়ে ঢুকেও বেআইনি ভাবে থেকে গেলে তাঁদের আটক করে ফেরত পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইন রয়েছে। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে মুসলিম ছাড়া বাকিদের এর থেকে রেহাই দেওয়া হবে। তাঁদের আর বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর তকমা দেওয়া হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ২০১৫ ও ২০১৬-র দু’টি বিজ্ঞপ্তিতে একই কথা বলেছিল। এ বার পাকা আইনের ব্যবস্থা।
কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। কোন সালের পরে এ দেশে আসা মুসলিমদের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলা হবে? কোন সময়ের আগে এসে থাকলে রেহাই মিলবে? নাগরিকত্ব বিল তা নিয়ে নীরব।
অসম-চুক্তিতে বলা ছিল, ১৯৭১-এর ২৪ মার্চকে এনআরসি তৈরির ভিত্তিবর্ষ ধরা হবে। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তার আগে যাঁরা বাংলাদেশ থেকে অসমে এসেছেন, তাঁরা এনআরসিতে জায়গা পাবেন। অসমের এনআরসি থেকে ১৯ লক্ষের বেশি মানুষ বাদ পড়েছেন। অসমের মতো কি বাংলাতেও ১৯৭১-কেই সময়সীমা ধরা হবে? না কি নাগরিকত্ব আইন মেনে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারিকেই সময়সীমা ধরা হবে?
খাতায়-কলমে কোথাও সে কথা বলা নেই। বাংলায় ১৯৭১ বা ১৯৫০ ধরে এনআরসি তৈরি হলে কত মানুষ বাদ পড়বেন? সংখ্যাটা যতই হোক, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের মনে আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছে। কেউ বাড়ির পুরনো দলিল খুঁজছেন। রেশন কার্ড ডিজিটাল করানোর জন্য লম্বা লাইন পড়ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়া হবে, কারণ তাঁরা অন্য দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। সংসদীয় কমিটিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, নাগরিকত্ব পেতে গেলে প্রমাণ করতে হবে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েই এ দেশে আসতে হয়েছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে প্রমাণ হবে, কেউ বাংলাদেশ থেকে এ দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছেন, না কি রুটিরুজির খোঁজে এসেছেন? প্রশ্নের উত্তর নেই। সরকার কোন পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ধরে নিল যে প্রতিবেশী দেশে হিন্দুদের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন চলছে এবং তাদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়া প্রয়োজন? জবাব নেই। কত জন হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-পার্সি-জৈন-খ্রিস্টান নাগরিকত্ব পাবেন? কোনও সমীক্ষা হয়েছে? না। সরকারি সমীক্ষা নেই।
এর থেকেও বড় প্রশ্ন তুলছে দেশের সংবিধান। যে সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। সংবিধানের ১৪তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইনের চোখে সবাই সমান। ভারতের ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে রাষ্ট্র কোনও ভাবেই ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ এবং জন্মস্থানের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করতে পারে না। নাগরিকত্ব বিলে ঠিক তা-ই হচ্ছে না কি? মুসলিম না হলে আশ্রয় মিলবে। মুসলিম হলে নয়। মায়ানমারে নিপীড়িত রোহিঙ্গারা এ দেশে আশ্রয় পাবেন না। বাংলাদেশ থেকে শিয়া মুসলিম বা পাকিস্তান থেকে আহমদিয়াদের আশ্রয় দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই।
ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের প্রশ্ন তুলে অসমের বিদ্বজ্জনেরা সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই মামলা করেছেন। অভিযোগ, এই বিল সংবিধানের পরিপন্থী। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, আগে সংসদে বিল পাশ হোক। তার পরে এর বিচার হবে।
নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় বার লোকসভা নির্বাচনে জিতে সংসদের সেন্ট্রাল হলে পা দিয়ে প্রথমেই সংবিধানে মাথা ঠেকিয়েছিলেন। তাঁর সরকার ও তাঁর দল কী ভাবে সেই সংবিধানের মাহাত্ম্য রক্ষা করে, সেটাই এখন দেখার।