চিকিৎসকের দায়

পশ্চিমবঙ্গ-সহ বারোটি রাজ্যে স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল শিক্ষার শর্তরূপে ‘বন্ড’ সই করিতে হয় চিকিৎসকদের। অনেকগুলি রাজ্যে তাঁহারা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হইয়া মুক্তি চাহিয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share:

ছবি: সংগৃহীত

সরকারি মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর পড়িবার শর্ত রূপে চুক্তি বা ‘বন্ড’ স্বাক্ষর অবৈধ নহে, বলিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত বলিয়াছে, চিকিৎসকের চুক্তিভঙ্গ সংবিধান অমান্য করিবার সমান। এই বক্তব্যটি মনোযোগ দাবি করে। নাগরিকের অধিকার যেমন সংবিধান নিশ্চিত করিয়াছে, তেমনই নাগরিকের কর্তব্যও প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। কিন্তু আইনের ফাঁসে নাগরিককে বাঁধিয়া কর্তব্যের খুঁটিতে বাঁধে নাই সংবিধান। নাগরিক আপন বুদ্ধিতেই নিজের কর্তব্য নির্দিষ্ট করিবে, জনহিতের পথে সে আপনিই হাঁটিবে, ইহাই প্রত্যাশা। আক্ষেপ, চিকিৎসকদের একাংশ সংবিধানের সেই প্রত্যাশাকে মর্যাদা দেন নাই। তাঁহাদের ক্ষোভ, সকলেরই আপন পেশাদারি জীবনে উন্নতির স্বাধীনতা রহিয়াছে, চিকিৎসকেরই বা থাকিবে না কেন? চিকিৎসকেরা স্নাতকোত্তর শিক্ষা সম্পূর্ণ করিয়া নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিতে পারেন না, তাঁহাদের সরকারের নির্দেশ অনুসারে গ্রামে গিয়া দুই-তিন বৎসর কাটাইতে হয়। উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিলম্বিত হইয়া যায়, বহু সুযোগ হারাইতে হয়। ইহা কি চিকিৎসকদের প্রতি অন্যায় নহে?

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ-সহ বারোটি রাজ্যে স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল শিক্ষার শর্তরূপে ‘বন্ড’ সই করিতে হয় চিকিৎসকদের। অনেকগুলি রাজ্যে তাঁহারা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হইয়া মুক্তি চাহিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্ট মনে করাইল, কর্তব্যের বন্ধন হইতে মুক্তি মিলিতে পারে না। সরকারি কলেজে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করিতে বহু অর্থব্যয় হয়। চিকিৎসকেরা সরকারি সহায়তায় পড়িবেন, অতঃপর সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় যোগ দিয়া কয়েক বৎসর গ্রামে গিয়া চিকিৎসা করিবেন, এই দান-প্রতিদানের উপরে গ্রামীণ চিকিৎসাব্যবস্থা নির্ভরশীল। চিকিৎসক তাঁহার ‘স্বাধীনতা’ খুঁজিবার অর্থ গ্রামের মানুষের প্রতি দায় অস্বীকার করা। কারণ সরকারি চিকিৎসা ব্যতীত বিশেষজ্ঞের পরিষেবা পাইবার উপায় গরিবের নাই। পাশ করিয়া অনেকে চুক্তি-নির্দিষ্ট টাকা ফিরাইয়া মুক্তি দাবি করেন। তাহা হয়তো আইনত বৈধ, কিন্তু নীতির দৃষ্টিতে কি সমর্থনের যোগ্য? চিকিৎসকদের নালিশ— সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হইতে সুলভ শিক্ষা আরও অনেকে পাইয়া থাকেন। তাঁহাদের তো চুক্তি নাই। চিকিৎসকই কেন চুক্তিবদ্ধ হইবেন? ইহার উত্তর, জনস্বার্থের নিরিখে চিকিৎসকদের পেশার সহিত অপরাপর পেশার যে তুলনা চলে না, এবং সেই ফারাকটির কারণেই তাঁহাদের নিকট প্রত্যাশাও ভিন্ন, এই কথাগুলি জানিয়াই তাঁহারা এই কলেজে ভর্তি হইয়াছিলেন। চয়নের অধিকার থাকিলে তাহার দায়ও লইতে হয়। তখন কাঁদুনি গাহিলে চলে না।

চিকিৎসকের প্রতিও কি সরকারের দায় নাই? গ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠাইলেই চলে না, তাঁহাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া জরুরি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে শল্যচিকিৎসক আছেন সেখানে রোগীকে অজ্ঞান করিবার কেহ নাই। বা, উদরের রোগের চিকিৎসা করিয়া দিন কাটাইতেছেন রেটিনা-বিশেষজ্ঞ। শূন্যস্থান ভরাইতে যে কোনও হাসপাতালে যে কোনও চিকিৎসক পাঠাইবার ক্ষমতা রাজ্যের আছে। কিন্তু সে বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের সহিত জনস্বার্থের সম্পর্ক খুঁজিয়া পাওয়া প্রায়ই দুষ্কর। জেলার সরকারি চিকিৎসকদের পেশাদারি চাহিদার প্রতি সরকার কতটা সজাগ? কেবল জোর খাটাইলে চলিবে না, সংবেদী হওয়াও জরুরি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement