প্রতীকী ছবি।
বীরভূম জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে এবং অন্যত্র আজও ঢেকারো পদবি যুক্ত মানুষ জন বসবাস করেন। এই গোষ্ঠীর অনেকে নামের শেষে ‘লোহার’ পদবিও লেখেন। ঢেকারো সমাজের এই সব মানুষজনকে আজও সমাজের একটা অংশ একটু ‘অন্য’ দৃষ্টিতে দেখেন। পরাধীন ভারতে এই জনগোষ্ঠীকে অপরাধপ্রবণ শ্রেণি হিসেবে মনে করা হতো।
ইতিহাসবিদদের একাংশ বলে থাকেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাঁওতালদের সাহায্য করেছিলেন ঢেকারো সম্প্রদায়ের মানুষ। সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনের পরে ইংরেজ সরকার এদের বিতাড়ন আরম্ভ করে, রুটিরুজি কেড়ে নিতে শুরু করে, অপরাধী বলে ঘোষণা করে। এর পর থেকে অসামাজিক কিছু ঘটলেই এদের জেলে পাঠানো হতো। ব্রিটিশ পুলিশ সেই আমলে ঢেকারোদের উপরে নানা অত্যাচার চালিয়েছে। এই গোষ্ঠীর বহু নিরীহ মানুষকে অনেক সময় বিনা অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা মামলায় জেল খাটিয়েছে। দীর্ঘদিন জেলে আটকে রেখে নির্মম অত্যাচার করায় অনেক ঢেকারোর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও পুলিশি অত্যাচার অব্যাহত থাকায় জনমানসে ক্রমে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ঢেকারো এবং সমগোত্রীয় কয়েকটি শ্রেণিকে অহেতুক অপরাধ-প্রবণ গোষ্ঠী রূপে যাতে দেখা না হয় এবং তাঁদের উপর হওয়া অত্যাচার ও শোষণ যাতে অবিলম্বে বন্ধ হয়, তার জন্য এ রাজ্য তথা দেশের বহু বিশিষ্ট মানুষ ও সমাজকর্মীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকেন। তাঁদের সার্বিক কল্যাণের কথা ভাবতে থাকেন তাঁরা।
অবশেষে গড়ে তোলা হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ ঢেকারো সমাজ কল্যাণ সমিতি’। ১৯৯৮ সালের ১৬ এপ্রিল লেখিকা ও সমাজকর্মী মহাশ্বেতা দেবীর বিশেষ উদ্যোগে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে গঠিত হয় উক্ত সমিতি। প্রধান উপদেষ্টা হন মহাশ্বেতা দেবী। পেশায় শিক্ষক ও লেখক সুহাস দাসকে করা হয় উপদেষ্টা। সম্পাদকের দায়িত্ব পান বীরভূমের রাজনগরের সাহাবাদের বাসিন্দা তথা ঢেকারো সমাজের অন্যতম প্রতিনিধি শিবদাস লোহার। সভাপতির পদে আসীন হন রাজনগরেরই কানমোড়ার বাসিন্দা ডোমন ঢেকারো। শিবদাসবাবু জানান, ১৯৯৮ সালের ৩০ অগস্ট আমদাবাদের ছারানগরে ভারতের বিভিন্ন বিমুক্ত যাযাবর জনজাতির প্রথম মহা সম্মেলন আয়োজিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। ছিলেন কর্মসূত্রে আমেরিকায় অধ্যাপিকা, লেখিকা, অনুবাদক, সমাজকর্মী ও বক্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পীভাক।
ওই সম্মেলনে থাকতে পারায় আজও নিজেকে ধন্য মনে করেন শিবদাসবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ঢেকারো সমাজের শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের অধিকাশই বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। তাদের শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় একাধিক শিক্ষাকেন্দ্র। গায়ত্রী চক্রবর্তীর আর্থিক সহায়তায় এগুলি বেশ কয়েক বছর ধরে ভাল ভাবেই চলছে।’’ অতীতে একাধিক বার এমনকি গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে সফর সঙ্গী হয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষাকেন্দ্র তথা স্কুলগুলি ঘুরে দেখার সুযোগ এই প্রতিবেদকেরও হয়েছিল। আজও বছরে এক বা একাধিক বার সুদূর আমেরিকা থেকে ছুটে আসেন ওই মহিলা। খোঁজখবর নেন এই সব অবহেলিত শ্রেণির মানুষ ও তাঁদের বাড়ির শিশুদের। তাঁদের সার্বিক উন্নয়ন হোক এবং পড়ুয়ারা পড়াশোনা করে যথার্থ মানুষ হোক— তার জন্য তিনি সর্বদাই সচেষ্ট থাকেন। বিদেশে থেকে যা আয় করেন, তার একটা বড় অংশ গায়ত্রী দেবী ভারতে এসে মূলত বীরভূমের ঢেকারো, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের খেড়িয়া শবর, লোধা শবরদের জন্য ব্যয় করে থাকেন নিঃস্বার্থ ভাবে। অতীতে মহাশ্বেতা দেবীর আদর্শে ও কাজকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে গায়ত্রী দেবীর এই সমাজসেবায় নিজেকে সমর্পিত করা। ঢেকারো সমাজ কল্যাণ সমিতির সদস্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এবং দীর্ঘ কয়েক বছর এই সব সামাজিক কাজকর্মগুলি প্রত্যক্ষ করে অনেকখানি টের পাওয়া গিয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে লৌহ আকরিক থেকে লৌহ নিষ্কাশন করে ও তার মাধ্যমে অস্ত্র তৈরি করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরবরাহ করতেন ঢেকারোরা। ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকারের রোষ নজরে পড়েন তাঁরা। তাঁদের অস্ত্র তৈরির কামারশাল বা ছোট কারখানাগুলি ধ্বংস করে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ। শুরু করে ধরপাকড়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন এই জনজাতির মানুষজনকে পুলিশ-প্রশাসন অযথা হেনস্থা করবে, সেটাই প্রশ্ন অনেকের। অনেকে মনে করেন, এর শুরুটা সেই ব্রিটিশ আমলের তৈরি করা দুর্বৃত্ত আইন বা ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট। চুরি না করলেও ঢেকারোদের চোর, অপরাধ না করলেও তাঁদের অপরাধী তকমা দেওয়া হতো। পরে আইন ও আইনের বিভিন্ন ধারার রদবদল, সংযোজন, বিয়োজন ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের মানসিকতা আজও তেমন বদলায়নি বলে অভিযোগ। ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরও এই শ্রেণির মানুষেরা অনেকখানি উপেক্ষিত অবহেলিত।
তবে মহাশ্বেতা দেবী ও তাঁদের মতো মানুষেরা এই শ্রেণির মানুষদের উপরে দশকের পর দশক চলতে থাকা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় এবং প্রশাসনিক স্তরে বারবার দরবার করায় কিছুটা হলেও মানসিকতায় বদল এসেছে। ঢেকারো সমাজ কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজনগর গাংমুড়িতে সমিতির একটি অফিস করা হয়েছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষেরা। আগে রানীগ্রামে অফিসটি ছিল। বর্তমানে গায়ত্রী দেবীর আর্থিক সহায়তায় চলা স্কুল বা শিক্ষাকেন্দ্রগুলি রাজনগর ব্লকের সাহাবাদ, টাবাডুমড়া, বেলেড়া, কানমোড়া, হরিপুর, সিউড়ির নাঙ্গুলিয়া, মহম্মদবাজারের বৈদ্যনাথপুর, রাসপুরের মতো এলাকাগুলিতে রয়েছে। বর্তমানে কয়েকটি কেন্দ্র সাময়িক বন্ধ, বাকিগুলি চলছে। দু’জন পরিদর্শক রয়েছেন ধনঞ্জয় লোহার ও উজ্জ্বল লোহার। চার জন শিক্ষক ও চার জন শিক্ষিকা রয়েছেন বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্বে। বই, খাতা, স্লেট, পেনসিল-সহ অন্য শিক্ষা সামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় পড়ুয়াদের। মিড-ডে-মিলের ব্যবস্থাও আছে। এই সব পড়ুয়া আবার গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা শিশুশিক্ষা কেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতেও যায় বলে বাসিন্দা ও অভিভাবকেরা জানিয়েছেন।
রাজনগর কানমোড়া গ্রামের মেয়ে দুখসারি লোহার ২০০৩ সালে মহাশ্বেতা দেবীর চেষ্টায় ও সাহায্যে ঢেকারো সমাজ থেকে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেন। বর্তমানে তিনি তাঁর শ্বশুরবাড়ি, ঝাড়খণ্ডের নলা থানার ঘুসরোকাটায় থাকেন। ঢেকারো গোষ্ঠীর কয়েক জন বলছিলেন, ‘‘আমরা তফসিলি জাতি বা জনজাতি, কোনওটাই নই। ফলে, নানা সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা সারা জীবন বঞ্চিত।’’ তবে কেউ কেউ জানান, ‘সাবকাস্ট’ যাঁরা লোহার লেখেন তাঁরা এসসি সার্টিফিকেট পেলেও ঢেকারো পদবিযুক্তেরা তা পাচ্ছেন না। দীর্ঘদিন এই দাবি তাঁরা জানিয়ে আসছেন বিভিন্ন মহলে।
এই বঞ্চিত, অবহেলিত শ্রেণির মানুষদের সার্বিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু সমাজকর্মী। আগামী দিনে আরও অনেক শুভানুধ্যায়ী এই ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ালে এই জনগোষ্ঠীর বর্তমান করুণ চিত্রটা অবশ্যই বদলাবে।
(লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)