ছবি: সংগৃহীত
মহামারির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার গুজবের অদ্ভুত মিল। চরিত্রে ও ব্যাপ্তির প্রক্রিয়ায়। দু’ক্ষেত্রেই মানুষ তিন-চার ধরনের। এক দল ‘সংক্রমণযোগ্য’, ইমিউনিটি না থাকলে মহামারির শুরুতে প্রায় সব মানুষই এ রকম। কিছু মানুষ ‘সংক্রমিত’; আর আছেন ‘আরোগ্য প্রাপ্ত’ ও ‘মৃত’, যাঁরা অসুখের আওতার বাইরে। আরও কিছু আক্রান্ত আছেন, যাঁদের অসুখের লক্ষণ স্পষ্ট নয়। মহামারি বা গুজব শুরু হয় এক-আধ জনের মাধ্যমেই। ‘আক্রান্ত’রা নিজেদের পরিধির মধ্যে ‘সংক্রমণযোগ্য’দের অসুখ বা গুজব ছড়াতে থাকেন। মহামারিতে কিছু মানুষ মারা যান, কিছু সুস্থ হয়ে ওঠেন। গুজবেও কিছু মানুষ ক্রমে সত্যিটা বুঝে যান। দু’ক্ষেত্রেই দ্রুত গতিতে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর উপর সার্বিক দখল নেয় মহামারি বা গুজব। দু’ক্ষেত্রেই কিছু মানুষ বাদ থাকেন। মহামারি বা তথ্যমারি তাঁদের প্রভাবিত করতে পারে না। তাই একই ধরনের গাণিতিক মডেলে ব্যাখ্যা করা হয় ঘটনাপ্রবাহকে। তফাতও আছে। মহামারিতে ঘটনাপ্রবাহের একক ‘দিন’, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের একক ‘মিনিট’।
শেক্সপিয়রের হেনরি দ্য ফোর্থ নাটকে ‘গুজব’ নিজের সম্পর্কে বলে, “হাওয়া আমার ঘোড়া, যাতে চড়ে আমি পুবের প্রান্ত থেকে পশ্চিমের দিকচক্রবাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই, বর্ণনা করি পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা। আমি সারা ক্ষণ সব ভাষায় মিথ্যার বিষে পূর্ণ করি মানুষের কান।” আজকের দিনে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের হাত ধরে ‘গুজব’ আরও দ্রুতগামী। গুজবকে অবশ্য সব সময় বানিয়ে তোলা কথার ফুলঝুরি হতে হয় না। সত্যি খবরও যে কখনও কখনও জনস্বার্থে প্রচার করতে নেই, পেশাগত সেই সংযম মূলধারার মিডিয়ার অনুশাসনে থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত।
করোনা অতিমারিতেও ভাইরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর। ‘ইনফর্মেশন’ আর ‘এপিডেমিক’ জুড়ে, বিশেষজ্ঞেরা এর নাম দিয়েছেন ‘ইনফোডেমিক’। উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘তথ্যমারি’। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব কোভিড-১৯’কে ‘ভুল তথ্যের অতিমারি’ বলেছেন।
সমস্যা প্রবলতর হয়, যখন অতিমারি ও তথ্যমারি একসঙ্গে ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাসে অতিমারি বার বার হলেও কোভিডের ব্যাপারটা কিছু আলাদা। পার্থক্যটা আন্তর্জাল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বব্যাপী বিস্তারে। ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লু-র সময়েও সোশ্যাল মিডিয়া ছিল, কিন্তু তা এমন করে বিশ্বজয় করতে পারেনি। তখনও তা এমন ভাবে জীবনের প্রতিটা ওঠাপড়ার দখল নেয়নি। ইবোলা কিংবা জ়িকা মহামারির সময়ে তথ্যের মহামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। “একই পরিবারের পাঁচ জন ইবোলা আক্রান্ত হওয়ায় টেক্সাস শহরটাকেই কোয়রান্টিন করে দেওয়া হয়েছে”— এমন গুজব ফেসবুকে ‘শেয়ার’ করা হয়েছিল ৩৩০,০০০ বার। এমনকি ইবোলা জল, হাওয়া বা খাবারের মধ্য দিয়ে ছড়াতে পারে, এমন ভুল তথ্যও ছড়াতে থাকে অবিরাম। মার্কিন দেশের আয়ওয়া প্রদেশে ইবোলা ঢুকে পড়েছে, এমন খবরকে ‘মিথ্যে’ জানিয়ে বিবৃতি দিতে হয় সেখানকার জনস্বাস্থ্য বিভাগকে। তাই মহামারি এবং তথ্যমারির সহাবস্থান এ বারই প্রথম নয়। কিন্তু আগের মহামারিগুলির ব্যাপ্তি কম ছিল, এ বার সমস্যার মাত্রা তাই ভিন্ন। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ করোনাকে বলেছে— “প্রথম সত্যিকারের সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যমারি।”
আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ৬০ সেকেন্ডেই কেউ বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যেতে পারে। তাই সত্যি-মিথ্যে আর ঔচিত্যবোধ হারিয়ে যায়। গুজব ছড়ায় দু’টি কারণে। ভয়ে এবং উদ্দেশ্যে। মহামারির কারণ, বিস্তার, ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক, বিজ্ঞানী বা প্রতিষ্ঠানের নামে পছন্দমতো কথা বসিয়ে প্রচার চলেছে। জৈব অস্ত্রের তত্ত্ব থেকে মহামারির বিস্তার ও পদ্ধতি-প্রকরণ সম্পর্কে সত্যি-মিথ্যে খবর মানুষের মধ্যে ত্রাস, সংশয় ও উদ্বেগ জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। সেই সঙ্গে তা কখনও ছড়ায় ঘৃণা, জাতিগত বিদ্বেষ। ভারতের মতো দেশের ৩৫ কোটি ব্যবহারকারীর বেশির ভাগেরই তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি জানা নেই। নেই তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সম্যক ধারণাও।
লকডাউনের ফলে গোটা দুনিয়াতেই নাগরিক জীবনের অনেকটাই ‘স্ক্রিন টাইম’-এ উৎসর্গীকৃত হয়েছে। লকডাউনের সময়ে এর ব্যবহার স্বাভাবিক সময়ের থেকে কয়েক গুণ বেড়েছে সর্বত্রই। অতিমারি আর তথ্যমারি তাই হাত ধরে ছোটার অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। ‘হু’-র ডিরেক্টর জেনারেল বলেছেন, “করোনাভাইরাস নিয়ে ভুল খবরই বোধ করি সবচেয়ে সংক্রামক।” এর ফলে গণ-আতঙ্কের সৃষ্টি হতে পারে। গুজবের সঙ্গে লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যেমন, কোভিড সংক্রান্ত গুজবের সঙ্গে লড়াই করতে এবং ভুল তথ্য সংশোধন করার জন্য ‘হু’ প্রস্তুতি নিচ্ছে। মজার কথা, ঠিক খবর বিস্তারের অন্তর্নিহিত গাণিতিক মডেলও মহামারি বা গুজবের গাণিতিক মডেলের মতোই। কিন্তু ‘ঠিক’ তথ্য ছড়াতে মানুষের আগ্রহ কম। এর বিস্তার তাই অনেক শ্লথ।
তবে অতিমারির সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া যে কেবল সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারে, তা-ও ঠিক নয়। মধ্যযুগীয় অতিমারি এবং লকডাউনের সঙ্গে আজকের করোনা-কালের বিস্তর তফাত। পৃথিবীর ২৫০ কোটি ব্যবহারকারীর নিত্য দিনের পোস্টের বিপুল তথ্যভান্ডার নিংড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির আগেই পূর্বাভাসও তৈরি করে ফেলা যায়। সে চেষ্টাও হয়েছে নানা দেশে। ও দিকে, লকডাউনে বন্ধুজনের সঙ্গে যোগাযোগের অনিবার্য মাধ্যমও সোশ্যাল মিডিয়া। জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য চনমনে রাখতে তা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। সাইবারসাইকোলজি, বিহেভিয়ার, অ্যান্ড সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জার্নালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রধান সম্পাদক ব্রেন্ডা ওয়াইডারহোল্ড আলোচনা করেছেন, কী ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া অতিমারির সময়ে উদ্বেগ কমাতে পারে। রঙ্গ-রসিকতা ও হালকা পোস্টগুলি দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সহায়তা করে। জুনের মাঝামাঝি নেচার-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে টুইটার পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, ২৬ মে থেকে ৮ জুন টুইটারের ইতিহাসে সবচেয়ে বিষণ্ণ পক্ষকাল। সে বিষণ্ণতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে।
করোনা ঠেকানোর প্রচারেও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োগ হয়েছে। ‘হু’-র ‘#সেফহ্যান্ডসচ্যালেঞ্জ’-এ যোগ দিয়েছেন সেলেব্রিটিরা। ভিয়েতনামের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’-এর উদ্যোগে হিট পপ গানের রিমিক্স গেয়ে শোনান দুই গায়ক, তা পৃথিবীময় জনপ্রিয় হয়। ও দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রিটেন ও হল্যান্ডের রাজপরিবারের সদস্যদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও প্রচার চলেছে।
আসলে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমে গ্রাস করে নিয়েছে আমাদের অস্তিত্ব, ভাবনা। অজস্র দাঙ্গা, সামাজিক অস্থিরতা সংগঠিত বা ত্বরান্বিত করেছে, আবার কায়রোর তাহরির স্কোয়ার থেকে ‘আরব বসন্ত’ ছড়িয়ে পড়ার মূলেও ছিল ফেসবুক। সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরেই হয়েছে হংকংয়ের আন্দোলন। সোশ্যাল মিডিয়া তাই আলাদিনের দৈত্যের মতোই ক্ষমতাশালী! দীর্ঘ দিন ধরেই বোতল থেকে বার করে দৈত্যটার সুপরিকল্পিত ব্যবহার হয়ে চলেছে দেশে দেশে। কখনও দাঙ্গা ছড়াতে, কখনও নির্বাচনের সময়, নির্বাচন না থাকলে রাজনৈতিক মতামত গড়ে তুলতে। আজ মহামারির কালবেলায় তাকে পুনর্মূষিকো করে ফেলা অসম্ভব। বরং করোনাভাইরাস সোশ্যাল মিডিয়াকে দিয়েছে এক সুযোগ— আমাদের জীবনধারায় বিমূর্ত অস্তিত্ব থেকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে উত্তরণের অবকাশ।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত