এর মধ্যে একটা অসাধ্যসাধন করেছে শিশির— শিবুদাকে দিয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলিয়েছে। বিস্তর আপত্তি, চাপান-উতোর, অনেক মান-অভিমানের পর হাস্যমুখ প্রোফাইল পিকচার সমেত শিবু সেন যোগ দিয়েছেন ফেসবুকে। এবং, মজে গেছেন। অনলাইন বৈঠকখানায় তা নিয়েই হাসাহাসি করছিল তপেশ-শিশিররা, সেই সময় শিবুদা ঢুকলেন আড্ডায়।
‘যাক, তবু ফেসবুক থেকে মুখ তোলার ফুরসত পেলেন!’ স্বাগত জানায় তপেশ।
‘রসিকতা করছিস?’ শিবুদা গম্ভীর হতে চান, কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার ছেলেমানুষি লজ্জাও তাঁর মুখে। ‘তবে একটা কথা মানতেই হবে, বুঝলি— চোখকান খোলা রাখলে ফেসবুকে বিশ্বরূপ দর্শন সম্ভব। কৃষ্ণের মুখগহ্বর।’
‘তা কী রকম দেখলেন বিশ্বরূপ? যুদ্ধে ফের উৎসাহ পাচ্ছেন?’ সূর্য প্রশ্ন করে।
এক কাপ কফি বানিয়েই আড্ডা মারতে বসেছেন শিবুদা। আয়েশ করে চুমুক দিলেন। তার পর বললেন, ‘‘তোরা তো ধরে-বেঁধে ফেসবুকে ঢোকালি। এক দিন বসে বসে স্ক্রোল করছি ফেসবুকে, হঠাৎ একটা ভিডিয়ো এল। মাসদুয়েক আগের ভিডিয়ো, তারিখ দেখলাম। এক পরিযায়ী শ্রমিকের সাক্ষাৎকার। হেঁটে ফিরছে ঘরে, হাক্লান্ত। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, এই অবস্থার জন্য কি আপনি মোদীকে দোষ দেন? একটুও না ভেবে ছেলেটা বলল, ‘মোদীজি ক্যা করেঙ্গে? ইয়ে তো হমারা নসিব হ্যায়।’ একে যদি বিশ্বরূপ না বলিস, কাকে বলবি?’’
‘ধুর, ও ব্যাটা বিজেপি!’ ফুট কাটে তপেশ।
‘এখানেই তোদের সমস্যা। আগে থেকে বলে দিলি, বিজেপি।’ চটে যান শিবুদা। ‘বিজেপি যদি হয়ও, তাতে কী? এতখানি সমস্যা হওয়ার পরও লোকটা মোদীকে দোষ দিচ্ছে না, নিজের কপালকে দুষছে— শুধু বিজেপি হলেই এটা হয়?’
শিবুদার ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু হয় তপেশ। বলে, ‘তা হলে আপনিই বলুন।’
‘হুম। বল দিকিনি, এই লোকটার পরিচয় সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করতে পারিস?’ শিবুদা প্রশ্ন করেন।
‘আন্দাজ করি, তার পর আবার আপনার ধমক খাই!’ তপেশ ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘মাথা খাটিয়ে বললেই আর ধমক খাবি না। যাক গে, লোকটার সম্বন্ধে কিছু না জেনে যদি একটা কথা বলতে হয়, তা হলে বলব, সে তথাকথিত নিচু জাতের মানুষ। পোশাক দেখে, কথা শুনে বলছি না— ভারতে গরিব মানুষদের মধ্যে, অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে নিম্নবর্ণের মানুষ এত প্রবল রকম বেশি যে কোনও এক জন পরিযায়ী শ্রমিক নিম্নবর্ণের মানুষ হবে, সেই সম্ভাবনা জোরদার। সামান্য স্ট্যাটিস্টিক্স ঘাঁটলেই দেখবি, ভারতে শিডিউলড কাস্ট, শিডিউলড ট্রাইবের মানুষরা সবচেয়ে গরিব। মানে দাঁড়াল, পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে নিম্নবর্ণের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটাই হল আমাদের গল্পের সবচেয়ে বড় ক্লু।’ শিবুদা থামলেন। একটা সিগারেট ধরালেন।
বাকিরা চুপ। এমনকি তপেশও এক বার কিছু একটা বলতে গিয়ে চেপে গেল। শিবুদা একটু দম নিয়ে বললেন, ‘এতখানি যন্ত্রণা সহ্য করছে, অথচ সরকারকে দোষ দিচ্ছে না লোকটা— এটা স্ট্রাইকিং। শুধু এই লোকটাই, না অন্যরাও? দিনকয়েক গুগল করলাম সমানে— দেখলাম, কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল যা-ই বলুক, লিবারালরা যতই চেঁচান, পরিযায়ী শ্রমিকরা যেখানে যা বিক্ষোভ করছে, সেটা মূলত বাড়ি ফেরার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকুও হচ্ছে না বলে। সেই ব্যবস্থার দাবিতে। কিন্তু, দেশের অবস্থা ঠিক এই রকম কেন যে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের কথা না ভেবেই দুম করে লকডাউন চালু হয়ে যেতে পারে, কাজের জায়গাগুলো এই রকম কেন যে আশ্রয়হীন শ্রমিককে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও দিতে পারে না, মাইনের অবস্থা এই রকম কেন যে শ্রমিকের হাতে এক মাস চালানোর মতো টাকাও জমে না কখনও— এই বেসিক প্রশ্নগুলো ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা করছে না। এই অবস্থার জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলছে না। কেন?’
‘আপনি বলছেন, লোকগুলো নিম্নবর্ণের বলে এই খারাপ অবস্থা সহ্য করার অভ্যাস তাদের জন্মগত? সেই কারণেই তারা প্রতিবাদ করছে না?’ প্রশ্ন করল সূর্য। গলার সুরে স্পষ্ট, কথাটা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না তার।
‘এগজ়্যাক্টলি।’ সূর্যর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নেন শিবুদা। ‘কথাটা শুনতে খারাপ, কিন্তু এখনও, স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর কেটে যাওয়ার পরও, যাবতীয় সংরক্ষণ-টংরক্ষণ সত্ত্বেও, শুধু দলিত পরিচিতির কারণে মানুষকে কতখানি অপ্রেশন সহ্য করতে হয়, ভেবে দেখ। তার ওপর দারিদ্র। আমরা মধ্যবিত্তরা যে পরিস্থিতি কল্পনাই করতে পারি না, এই মানুষগুলো স্বাভাবিক অবস্থাতে সেই ভয়াবহতার মধ্যে বাঁচে। তোরা তো কানেম্যানের প্রসপেক্ট থিয়োরির কথা জানিস— কী অবস্থায় গিয়ে পড়ছি, শুধু সেটার ওপরই খারাপ থাকার পরিমাণ নির্ভর করে না; কোত্থেকে গিয়ে পড়ছি, সেটা জানা জরুরি। এই মানুষগুলো যে অবস্থায় বাঁচে, তার পর লকডাউনের ইমপ্যাক্ট আমাদের অবস্থান থেকে বোঝাই সম্ভব নয়।
‘এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন করলাম কর্ণকে। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে পড়ায়, আর চব্বিশ ঘণ্টা বিহেভিয়রাল ইকনমিকস নিয়ে ভাবে। বললুম আমার মাথায় কী ঘুরছে। কর্ণ বলল, “একটা কথা ভেবে দেখেছেন— হেডনিক অ্যাডাপ্টেশন ছাড়া এ জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না?” শুনে, কী বলব, মাথায় বাল্ব জ্বলে উঠল। ঠিক, কেন এই পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজেদের অবস্থা নিয়ে বেসিক প্রশ্নগুলো করে না, তার একমাত্র ব্যাখ্যা হল হেডনিক অ্যাডপ্টেশন— তারা এই অবস্থাটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে।’
ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে শিবুদার চোখ। শিশির বলে, ‘একটু খোলসা করলে হয় না?’
‘বিলক্ষণ হয়, কিন্তু তার আগে আর এক কাপ কফি দরকার। আমি চাইছি না, আমার সোল চাইছে!’ মুচকি হেসে কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠলেন শিবুদা। মিনিটদুয়েকের মধ্যে ফিরলেন, হাতে ধূমায়িত কফির কাপ। ‘যত বার এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, বুঝলি, প্রতি বারই দেখা গিয়েছে যে ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টে পা বাদ যাওয়া, বাকি জীবন হুইলচেয়ারে কাটাতে বাধ্য হওয়া মানুষরাও মোটের ওপর গড়পড়তা মানুষের মতোই সুখী জীবন নিয়ে। মানে, যে ঘটনায় গোটা জীবনটা পাল্টে গেল, সেটা জীবনের ভাল থাকায় তেমন প্রভাবই ফেলছে না। অথচ, পা ভেঙে মাসদুয়েকের জন্য শয্যাশায়ী, তার পরই আবার নর্মাল জীবনে ফিরতে পারবে, এ রকম লোকরা ভয়ানক অসুখী। ভেবে দেখ, কাণ্ডজ্ঞান তো বলে ঠিক উল্টোটা হওয়ার কথা। তা হলে?
‘এরই নাম হেডনিক অ্যাডাপ্টেশন— খারাপ হোক বা ভাল, কোনও পরিস্থিতি যদি মানুষের কাছে অপরিবর্তনীয় হয়, তা হলে মানুষ সেটাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নেয়। সচেতন ভাবে নয় অবিশ্যি। বেঁচে থাকার জন্যই এই ধরে নেওয়াটা জরুরি। এবং, ভাল বা খারাপ থাকার ওপর আর এই ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার প্রভাব পড়ে না। এ বার পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভাব। তারা জন্ম থেকে দারিদ্রের মধ্যে থেকেছে, সঙ্গের কষ্টগুলোকেও স্বাভাবিক বলেই জেনে এসেছে। ‘নিচু জাতের লোক’ বলে জেনেছে, কার্যত বিনা প্রতিবাদে উচ্চবর্ণের অত্যাচার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। হেডনিক অ্যাডাপ্টেশনের কতগুলো পথ আছে, বুঝলি— নিজের পরিস্থিতির জন্য নিজেকে দোষী ভাবা, এই অবস্থাকে ঈশ্বরের ইচ্ছে ভাবা, চেনাজানার মধ্যে অন্যদেরও একই অবস্থায় থাকতে দেখলে অবস্থাটাকে সহনীয় ভাবা— এই রকম। পুরো অবস্থাটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরের একটা বড় ছকের, বলতে পারিস একটা কসমিক ডিজ়াইনের পার্ট হিসেবে দেখলে সেটাকে মানতে সুবিধা হয়। এ বার খেয়াল করে দেখ, যে ছেলেটার ভিডিয়ো থেকে এতগুলো কথা বললুম, ছেলেটা কী বলেছিল— ইয়ে তো হমারা নসিব হ্যায়। আমার ভাগ্য। নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা ভাগ্য। এ বার ভাব, সেই ভাগ্যের জন্য সে অদৃষ্টকে দোষ দিতে পারে, প্রধানমন্ত্রীকে দোষ দেবে কেন?’
একটানা এতখানি কথা বলে রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন শিবুদা। শরীর নানা রকম ভাবে বয়সের কথাটা জানিয়ে দেয়। সবাই চুপ। তার পর তপেশ, খানিক আপন মনেই, প্রশ্ন করে, ‘আপনি বলছেন, এত দলিত রাজনীতি, এত আন্দোলনের পরও নিম্নবর্ণের মানুষ বিনা প্রশ্নে এই বিপুল অস্বাভাবিকতাকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিচ্ছে? ভেবে বলছেন কথাটা?’
‘ভেবেই বলছি।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন শিবুদা। ‘মানুষ সচেতন হয়েছে তো বটেই— আগে উচ্চবর্ণের লোক যে আচরণ করে বেমালুম পার পেয়ে যেত, এখন তাতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয় বিস্তর। কিন্তু কী জানিস, অসুখের যেমন অ্যাকিউট আর ক্রনিক এই দুটো ভাগ হয়, নিপীড়নেরও আসলে এই দুটো ভাগ আছে। অ্যাকিউট নিপীড়ন যেহেতু একটা ঝটকার মতো আসে, তা নিয়ে হল্লাও হয়। ক্রনিক নিপীড়ন অনেক সময় চোখেও পড়ে না, সেটা এতই স্বাভাবিক। নিম্নবর্ণের দারিদ্র কিন্তু ক্রনিক।’
‘মোদ্দা কথাটা কী জানেন— এতগুলো মানুষকে এ ভাবে বিপন্ন করেও শাসক দলকে ভোটবাক্সে তার ফল ভুগতে হবে না।’ সূর্যের গলায় বিরক্তি স্পষ্ট।
‘এখনই হাল ছেড়ে দিস না। অসম্ভবকে সম্ভব করার নামই তো রাজনীতি। কিন্তু, তার জন্য আগে সত্যিটা জানতে হবে।’ আশ্বাস দিলেন শিবুদা।