“খাল-বিল,নালা-জলা একাকার, গুড়গুড়িয়া ঘোরোস্রোত চলে নগরভ্রমণে, পাগলাচণ্ডী যায় পথ পরিক্রমায়। সে রূপবতী অঞ্জনা স্রোত প্রহরে প্রহরে রূপ বদলায়। কখনও ময়ূরাঞ্জন, কখনও শ্রীকর,কখনও ফণী,কখনও নীল নীরদ– সে শ্রাবণ বর্ষণে দেশান্তরী। সবাই ফেরে ভাদ্র সংক্রান্তির শীতল অন্ন-ব্যঞ্জনে, কেউ উমার সঙ্গে মহাবোধনে। হারিয়ে যায় একজনা, একটি কুমারী অলকানন্দা। দু-কুলের পাখি সুর হারায়, দু-পাড়ের বন স্বর হারায়, দু-তীরের দেবালয় মন্ত্রধ্বনি হারায়, দু-পাশের জনপদ গীত হারায়। কেউ বলে অলকানন্দা এখন হিমালয়বাসী, কেউ বলে দেবলোকের বাসিন্দা। অলকানন্দা হারিয়েছে, কিন্তু গাঙ্গনি-খড়িয়া-জলঙ্গি হারাতে চায় না জনপদবাসী। পৌষ সংক্রান্তিতে ধান্যগাছার বেড়িতে বাঁধে মাথাভাঙ্গা, চূর্ণি, ইছামতি, ভৈরবে। যেদিকে চোখ যায় যেন জেগে থাকে নদীকূল, নদীগর্ভ, নদীকান্ত, নদীতট, নদীপথ। কান্ডার বলে সেই সংখ্যাহীন স্রোত হতে ভাগীরথীর দু-পাশের এই দু-কুল নাম পেল নদিয়া।” (ধনপতির সিংহল যাত্রা— রামকুমার মুখোপাধ্যায়)
সেই কবেকার কথা। ধনপতি সদাগর সিংহল যাত্রার সময় ‘নয় দীয়ার’ নদীতীরে রাত্রিবাস করার সময়ে প্রাচীন এই জনপদের মানুষের মুখেই শুনেছিলেন তাঁদের এক প্রিয় নদী অলকানন্দাকে হারিয়ে ফেলার গল্প। জেনেছিলেন, এক বার নদী হারানোর বেদনা থেকে কেমন করে নদীকে সন্তানের মতো স্নেহে লালন করার ইচ্ছার জন্ম হয়েছিল নদিয়াবাসীর মনে। আরও শুনেছিলেন সংখ্যাহীন নদীস্রোত থেকেই কী ভাবে এই জায়গার নাম নদিয়া হয়েছিল। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন, তখন থেকেই নদীদের হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সে কালের বর্ধিষ্ণু নগর নদিয়ার অলকানন্দা কী ভাবে হারিয়েছিল, তা অবশ্য জানতে পারেননি ধনপতি সদাগর। জানার কথাও নয়। কিন্তু জেনেছিলেন কী ভাবে মানুষ যত্নবান হয়েছিল জলঙ্গি, অঞ্জনা, ইছামতি বা চূর্ণীকে বেঁধে রাখতে। নদিয়ার পাশেই বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামের বাসিন্দা মুকুন্দরামের বাড়িও ছিল এক নদীর পাড়ে। রত্না নদী। তাঁর মঙ্গলকাব্য এত নদীময় হয়তো সেই কারনেই।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, ষোড়শো শতকের মধ্যভাগে মঙ্গলকাব্য লিখতে বসে মুকুন্দরাম কেন নদী নিয়ে পড়লেন! আশ্চর্যজনক ভাবে যে যে নদীর কথা কবিকঙ্কনের চণ্ডীমঙ্গলের ‘বণিক খণ্ড’ অনুসরণে লিখিত ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’য় উল্লিখিত হয়েছে, সেই সব নদীর বেশির ভাগই হয় হারিয়ে গিেয়ছে, নয়তো হারানোর পথে। অলকানন্দা হারিয়েছিল সেই মধ্যযুগেই। তার পর একে একে হারিয়েছে আরও কত নদী, জলবাহিকা। অঞ্জনা, গুড়গুড়ে। ভাগের মা হয়ে গঙ্গা অবশ্য এখনও বইছে। কিন্তু সে নদীকে দেখে গণগায়ক গান বাঁধেন ‘ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন?’ সেই জিজ্ঞাসা বুকে নিয়ে নদী বয়ে চলে উৎস থেকে বিলুপ্তির মোহনার দিকে। নদী হারানোর উৎসবে মানুষ কাঁদে ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।’ নদীপাড়ে বাজে বিসর্জনের ঢাক! আর মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে পাগলাচণ্ডী, জলঙ্গি, চুর্ণি বা ইছামতিরা কান পেতে শোনে সেই শব্দ।
নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শো শতাব্দীর মধ্যে গঙ্গার প্রবাহপথের আমূল পরিবর্তন ঘটে। গঙ্গা কোন পথে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল, সে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। প্রায় দু’শো বছর ধরে নানা লেখা, রিপোর্ট ও আলোচনায় নদী বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ভাগীরথী-হুগলী নদীকেই গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহপথ বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কবে থেকে গঙ্গার জল ভাগীরথী খাত ছেড়ে পদ্মার খাতে বইতে শুরু করেছিল, সে ব্যাপারেও নানা মুনির নানা মত। তবে সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, এটা একদিনে হয়নি। বারো থেকে ষোড়শো শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় ধরে একটু একটু করে গঙ্গার মূল জলস্রোত ভাগীরথী থেকে পদ্মার খাতে চলে যায়। নদী গবেষকদের মতে, এই পরিবর্তনের সময় ভৈরব, জলঙ্গি, মাথাভাঙ্গা, গড়াই প্রভৃতি নদী কিছু সময়ের জন্য সক্রিয় হয়ে পরে আবার মজে যায়। মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল লিখেছেন ওই ষোড়শো শতাব্দীতেই। অর্থাৎ, গঙ্গার ভাঙচুর যখন তুঙ্গে। নদীপাড়ের মানুষ হিসেবে তিনি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন বদ্বীপের প্রধান নদীর এই ধারাবদল হয়তো আরও অনেক নদীর মৃত্যুর কারণ হবে। তাঁর সে আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে বারবার মিলেছে।
সময়টা ১৫১০ সাল। চৈতন্যদেব তাঁর সন্ন্যাসগ্রহণের বারোদিন পর ফিরে এসেছেন নদিয়ার শান্তিপুরে। নবদ্বীপ থেকে দলে দলে লোক ঘাট পার হয়ে ছুটছে সেখানে। এত ভিড়ে যারা নৌকো পাচ্ছে না, তারা সাঁতরে নদী পার হচ্ছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ সে দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখছেন— “অনন্ত অর্বুদ লোক হৈল খেয়াঘাটে, খেয়ারি করিতে পার পড়িল সংকটে। কেহ বান্ধে ভেলা, কেহ ঘট বুকে করে, কেহ বা কলার গাছ ধরিয়া সাঁতরে।” কিন্তু প্রশ্ন হল, এ নদী কোন নদী? গঙ্গা বা ভাগীরথী? অথচ, ১৬৬০ সালের ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্র বলছে সেই সময় গঙ্গা নবদ্বীপের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হত। আর নবদ্বীপ এবং শান্তিপুর দু’টি জায়গাই ছিল নদীর পূর্বপাড়ে। তা হলে তো নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর যেতে নদী পার হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে এ কোন নদী? চৈতন্য সমকালীন সেই নদী কি আসলে জলঙ্গি? ভ্যানডেন ব্রুক যাকে বলেছেন ‘দ্য গনগ্যাটসি সপ্রুইস।’ যার উৎস থেকে মোহনা সবটাই নদিয়া জেলার মধ্যে অবস্থিত। যদি তাই হয় তা হলে জলঙ্গির অস্তিত্ব পাঁচশো বছরেরও বেশি প্রাচীন! এহেন নদীও মৃত্যুর দিন গুনছে। তার জন্য প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে মানুষের লোভ, প্রশাসনের উদাসীনতা, ইতিহাস ভুলে থাকার অভ্যাস।
তাই জলঙ্গির মূল দৈর্ঘ্যের ২২০.৫ কিলোমিটারের মধ্যে অনেকটা নদীর আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কোথাও সে নদীর বুকে এখন সবুজ আবাদি জমি, তো কোথাও রাজ্য সড়ক। নদিয়ার ‘লাইফলাইন’ কিন্তু গঙ্গা নয়, জলঙ্গি। কেননা গোটা নদিয়ায় গঙ্গা বইছে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। সেখানে করিমপুরের উত্তর প্রান্তের চরমধুবোনা থেকে উৎপন্ন হয়ে নবদ্বীপের কাছে স্বরূপগঞ্জে গঙ্গায় মেশা পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে জলের মায়ার বেঁধে রেখেছিল জলঙ্গি। এখন চরমধুবোনা থেকে মোক্তারপুর পর্যন্ত কম-বেশি ৪৮ কিলোমিটার নদী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। বাকি ১৭২.৫ কিমির অবস্থাও বড় করুণ।
জলঙ্গি নদীর হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা শুরু হয়েছিল গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে, সেই ১৯৫৯ সালে। তখন জলঙ্গি–করিমপুর রোড তৈরির সময়ে সরকারি উদ্যোগে জলঙ্গি নদী বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পর ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’।
কেউ নদীর বুকে মাটি ফেলে আবাদি জমি বাড়িয়ে নিয়েছেন। কেউ শীতের মরসুমে লরি লরি মাটি ফেলে নদীর দু’পারকে কাছে আনেন। তার পর নদীর বুকে খানচারেক নৌকো বেঁধে, তার উপর তক্তা ফেলে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করেন তেহট্টের ঘাট ইজারা নেওয়া ব্যক্তিরা। তার পর আছে মৎস্য সমবায়গুলি। যারা লিজের নামে নদী যেন কিনেই ফেলেছে, এমন মেজাজে নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে ব্যবসা করছে। এ সব কথা কে না জানে! কিন্তু কোনও প্রতিকারের ব্যবস্থা কেউ করে না। ফলে, নদীরা এগিয়ে যায় মৃত্যুর কাছাকাছি।
আর একটু পরের কথা। সপ্তদশ শতকে জলঙ্গির একটি শাখা অঞ্জনা নামে কৃষ্ণনগরের কাছ থেকে বেড়িয়ে দোগাছিতে দু’টি ধারায় বিভক্ত হত। উত্তরের শাখাটি চিত্রশালি হয়ে হাঁসখালিতে চূর্ণীতে মিশত। দক্ষিণ শাখাটি জয়পুর, ধর্মদহ, বাদকুল্লা, চন্দনদহ হয়ে ব্যাসপুরের কাছে চূর্ণীতে মিশেছে। দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের ‘ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিত’ (১৮৫৭) বইতে অঞ্জনার কথা পাওয়া যায় বিশদ ভাবে।
নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকারের অভিমত, ১৬৮৩-৯৪ সালে রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎসমুখটি বন্ধ করে দেওয়ার পর নদীটি ধীরে ধীরে মজে যায়। চন্দনি গাঁয়ের সেই অঞ্জনা নদী এখন শুধু ‘সহজপাঠে’ই সীমাবদ্ধ।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের নদী মানচিত্র অনেকটাই বদলে গিয়েছে আমাদের যত্নের অভাবে। নদিয়া জুড়ে হারিয়ে গিয়েছে বা হারিয়ে যাওয়ার মুখে এমন নদীর তালিকা তৈরি করলে তার দৈর্ঘ্য নেহাত কম হবে না। নদী সম্বন্ধীয় একটি বই অনুসারে, কৃষ্ণনগরের অঞ্জনা, সুবর্ণবিহারের অলকানন্দা, নবদ্বীপের মরিগঙ্গা, কৃষ্ণনগর-শান্তিপুরের কাছে বেহুলা, পাবাখালির কাছে ইন্দুমতী, চাকদহের কাছে গঙ্গিনী, বগুলার কাছে গোরাগঙ্গিনী, আসাননগরের কাছে কলিঙ্গ-পলদা, ভীমপুরে ঝোড়ের খাল, কালীগঞ্জে পাগলাচণ্ডী, করিমপুর সংলগ্ন এলাকায় ভৈরব, কুমারী, ভৈরববাঁকি, চাপড়ার কাছে হাউলিয়া বা মুড়াগাছার কাছে ছোট জলঙ্গি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ইচ্ছামতি, ভৈরব, চূর্ণী এখন মরসুমি নদী। বর্ষার কয়েক মাস তাদের বেঁচে থাকা।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর থেকে কৃষিজমির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শুরু হয় নদীর দুই পাড়ে বাঁধ নির্মাণ। ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসকেরা সেনা বাহিনীর দ্রুত যাতায়াতের জন্য রেলপথ নির্মাণ শুরু করে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল সড়ক পথের দৈর্ঘ্য। পরবর্তী কালে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নগরায়ন এবং লোভী মানুষের অপরিণামদর্শিতা। সভ্যতা গড়ে ওঠা পিছনে নদীর ভূমিকা এবং বিশ্বের নদীমাতৃক বিভিন্ন সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে মানুষের ভূমিকা নদীমৃত্যুর হার বাড়িয়ে তুলেছে।
নদিয়ার নদী হারানোর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
(উদ্ধৃতির ভিতর বানান অপরিবর্তিত)