মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী প্রতিবাদের চিহ্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আধভাঙা মূর্তিরা। কখনও প্রতিবাদীরা ভেঙেছেন, কখনও প্রতিবাদের মুখে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভেঙে ফেলা হয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাস, রবার্ট ই লি-র মূর্তি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে ফেলেছে সেসিল রোডস-এর মূর্তি, লন্ডনে ভাঙা হয়েছে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন হেনরি ডান্ডাস, কোলস্টোনের মূর্তি। এই ছবি দেখেছে সারা বিশ্ব।
এই সূত্রে, চার বছর আগে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাত্মা গাঁধীর মূর্তি অপসারণের কথাও উঠে এসেছে সামনে। সেই মুহূর্তে প্রতিবাদের কারণ ছিল বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে গাঁধীর মনোভাব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে করা বহু বিতর্কিত মন্তব্য। দুই বছর প্রতিবাদ চলার পর মূর্তি সরাতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় মূর্তি ভাঙার কথাও স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসেছে। ডিস্ট্যালিনাইজ়েশন-এর সময়, নিকিতা ক্রুশচেভ-এর নেতৃত্বে বুদাপেস্ট, প্রাগ-এ স্ট্যালিন-এর মূর্তি ভাঙার কথাও উঠে এসেছে। এর পরেও, পেরেস্ত্রৈকা গ্লাসনস্ত-এর রাশিয়া বা ইউক্রেন দেখেছে লেনিন, স্ট্যালিনের মূর্তি ভাঙা। দু’বছর আগে ভারতে, ত্রিপুরায় রাজনৈতিক পালাবদলের পর পরই বুলডোজ়ারে ভাঙা পড়ছে লেনিনের মূর্তি। প্রায় একই সময় মুখে কালি পড়েছে শ্যামপ্রসাদের মূর্তিরও, কলকাতায়।
লক্ষণীয়, সব ক্ষেত্রেই মূর্তির উত্থান-পতন ঘটেছে রাজনীতি এবং ক্ষমতায় থাকা শাসকের রাজনৈতিক ইচ্ছে অনুযায়ী, অথবা পাল্টা রাজনীতির ধাক্কায়। কিন্তু রাজনীতি বা ক্ষমতায়পুষ্টদের গা-জোয়ারি নয়, মূর্তিকে শুধুই প্রতিবাদের মাধ্যম বলে গণ্য করে মুখর হওয়া— এ-ও কি সম্ভব?
রাজস্থানের জয়পুর দেখেছে এই বিরল প্রতিবাদ। প্রতিবাদের কেন্দ্রে দুই দলিত মহিলা। কান্তাবাই আহিরে ও শীলা পওয়ার। সাধারণ ভাবে ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ বা সমাজকর্মী বলতে আমরা যা বুঝি, তার থেকে তাঁরা অনেক দূরে। দু’জনেই পেশায় দিনমজুর। সামাজিক, রাজনৈতিক কোনও পরিচয়ই নেই। সাধারণ ভাবে, এঁদের প্রতি সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ হওয়াও সম্ভব নয়।
তবু ২০১৮ সালের অগস্টে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁদের ছবি। রাজস্থান হাইকোর্টের সামনে একটি মূর্তির গায়ে নিতান্ত শান্ত ভঙ্গিতে কালো রং স্প্রে করছেন। মূর্তিটি কার? চেনা মনীষীর মুখ নয়, খোঁজ করে জানা যায়— মূর্তিটি মনুর। আমাদের রাজ্যে খুব পরিচিত না হলেও, ভারতের অনেক জায়গাতেই বিষ্ণুর অবতার রূপে পূজিত হন মনু— যাঁর ‘মনুস্মৃতি’-র সঙ্গে পরিচিত আমরা। গ্রন্থটির বক্তব্য বহু তর্কের জন্ম দিয়েছে, জাতপাতের কুৎসিত রূপটিকে অস্ত্র করে দুর্বলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃতও হয়েছে। আর কান্তাবাই আহিরে? শীলা পওয়ার? জয়পুরে রাজস্থান হাইকোর্টের সামনে যাঁদের দেখলাম, কী তাঁদের আসল পরিচয়? কোথায় তাঁদের বাস?
অওরঙ্গাবাদের বালাপুর বস্তির বাসিন্দা কান্তাবাই আর শীলা। পেশায় দিনমজুর। এক জন সেলাইকলে কাজ করেন, অন্য জন কারখানায়। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীশের আমলে বি আর অম্বেডকরের বিরুদ্ধে রীতিমতো দাপাদাপি শুরু করেন বিজেপি সমর্থকরা। পাঠ্যবইয়ে কুৎসা শুরু হয়, ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাবাসাহেবের অসম্মানজনক কার্টুন। ভীমা কোরেগাঁও-এর ঘটনার পর মহারাষ্ট্রে অম্বেডকর ও দলিতদের বিরুদ্ধে কুৎসা আরও বৃদ্ধি পায়। একই সময়, দিল্লির রাস্তায়, আজাদ সেনা ও আরক্ষণ বিরোধী দল নামের দু’টি সংগঠন বাবাসাহেবের সংবিধান পুড়িয়ে ফেলে ভীমা কোরেগাঁও ঘটনার প্রতিবাদ করে।
চন্দ্রশেখর আজাদ ‘রাবণ’, সচিন খরাতের নেতৃত্বে দলিতেরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। শীলা বা কান্তাবাই কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের অংশ ছিলেন না, তাঁদের অভিপ্রায়ে কোনও রাজনৈতিক মদতও ছিল না । কিন্তু দলিত প্রতিরোধ, আলোচনার ফলে তাঁরা জানতে পারেন মনুর কথা, মনুবাদের কথা। এই জাতপাত, দলিতদের দুরবস্থার সূচনা মনুবাদ থেকে— সরলীকৃত পথে বোঝেন সে কথা। জয়পুরে কোর্টের সামনে মনুর মূর্তির কথাও জানতে পারেন। বাবাসাহেবের সংবিধানের ভিত্তিতে বিচার হয় যে কোর্টে, সেখানেই মনুর মূর্তির পুজো করা হয়? এর প্রতিবাদ প্রয়োজন।
কী প্রতিবাদ করতে পারেন দু’টি মেয়ে, কোনও সমর্থনের মঞ্চের সাহায্য ছাড়া? সে কথা ভাবেননি তাঁরা। অওরঙ্গাবাদ থেকে কোনও মতে ট্রেনের ভাড়া জোগাড় করে এসে পৌঁছন জয়পুর। দু’জন আপাত নিরীহ, শান্ত মুখের মেয়েকে বাধা দেননি কেউই। খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন জয়পুরের কোর্ট প্রাঙ্গণে। তার পর মনুর মূর্তির উপর তরতরিয়ে উঠে যান। কালি লেপনের সঙ্গে সঙ্গেই সবার মধ্যে শোরগোল পড়ে, মিডিয়া আছড়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই বাধা দেওয়া হয়, জেলবন্দি করা হয় কান্তাবাইদের। অনেক চেষ্টার ফলে কোনও মতে ছাড়া পান। যদিও বিচারব্যবস্থার কড়াকড়ি থেকে যায় তাঁদের উপর।
মনুর মূর্তি যথাসম্ভব পরিষ্কার করা হয়েছে। বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে কোর্ট প্রাঙ্গণে।
কোর্টের মধ্যে সক্রিয় বাবাসাহেব, তাঁর সংবিধান নিয়ে। বাইরে কান্তাবাইরা। জয়পুর কোর্ট থেকে ভীমা কোরেগাঁও, চন্দ্রশেখর আজাদ ‘রাবণ’ থেকে কিরুবা মুনুসামি, রুথ মনোরমা, আনন্দ তেলতুম্বডে থেকে সুশীল গৌতম। যুদ্ধ চলছে সর্বত্র।