সম্পাদকীয় ১

অপূরণীয় ক্ষতি

আর্থিক ক্ষেত্রের নজরদারি সংস্থা হিসাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের যে ভূমিকা— তাহাতে খামতির একটি মস্ত, এবং উদ্বেগজনক, উদাহরণ দেখা গেল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share:

রাজনীতির পাকেচক্রে ইতিমধ্যেই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঢের ক্ষতি হইয়াছে।

প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ঠিক কতখানি, বহু ক্ষেত্রেই তাহা বুঝিতে ঢের বিলম্ব হইয়া যায়। এমনও হয় যে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হইয়া যাওয়ার পর তাহার মাহাত্ম্যের পূর্ণ চিত্রটি সমাজের সম্মুখে ফুটিয়া উঠে। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নামক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির তেমন পরিণতি কাহারও কাম্য হইতে পারে না। রাজনীতির পাকেচক্রে ইতিমধ্যেই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঢের ক্ষতি হইয়াছে। ভারতীয় অর্থনীতির দ্বৈত ক্ষমতাকেন্দ্রের একটি মেরু হিসাবে যাহার প্রতিষ্ঠা ছিল, তাহা কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি সংস্থায় পরিণত হইতেছে। তাহাতে ব্যাঙ্কের প্রতি ভরসা কমিতেছে। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটিল, যাহা এই উদ্বেগকে একটি ভিন্নতর স্তরে লইয়া গেল। ঘটনাটি দেশের আর্থিক নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত নহে।

Advertisement

আর্থিক ক্ষেত্রের নজরদারি সংস্থা হিসাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের যে ভূমিকা— তাহাতে খামতির একটি মস্ত, এবং উদ্বেগজনক, উদাহরণ দেখা গেল। পঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ রহিয়াছে ঘটনার কেন্দ্রে। সম্প্রতি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানাইল, অনুসন্ধানে প্রকাশ পাইয়াছে যে বেলাগাম ঋণ দিতেছে সংস্থাটি। সত্য হইল, অনুসন্ধানটি স্বপ্রবৃত্ত ছিল না, সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ তাহাদের সমস্যা লইয়া রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হইয়াছিল। জানাইয়াছিল যে ব্যাঙ্কের খাতায় দীর্ঘমেয়াদি অনাদায়ী ঋণ জমিয়া আছে, তাহার প্রতিকার চাই। ব্যাঙ্কের কৃতিত্ব, সমস্যাটি জানিবার পর আর কালক্ষয় করে নাই, দ্রুত ব্যবস্থা করিয়াছে। কিন্তু, তাহাই তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার যথেষ্ট ভূমিকা নহে। সমস্যা যে হইতেছে, তাহা আগেভাগে জানাও শীর্ষব্যাঙ্কেরই কর্তব্য। শুধু পঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই নহে, এই নজরদারির কাজে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যর্থতা দীর্ঘমেয়াদি। এই মুহূর্তে কথাটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত করিয়াছে যে ব্যাঙ্ক নহে, এমন আর্থিক সংস্থার নজরদারির দায়িত্বও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপরই ন্যস্ত হইবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তাহার বর্তমান দায়িত্বেই যতখানি ব্যর্থ, তাহাতে নূতন দায়িত্বের বোঝাটি ব্যর্থতার খতিয়ান বৃদ্ধি করিবে বলিয়াই আশঙ্কা হয়। এই মুহূর্তে সতর্ক না হইলে বড় বিপদের আশঙ্কা।

বেলাগাম অনাদায়ী ঋণ সংক্রান্ত এই ঘটনাটি যে ক্ষণে ঘটিতেছে, তাহাও তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ককে কার্যত লুট করিয়াছেন নীরব মোদী ও মেহুল চোক্সী— সেই ঘটনা এখনও গণস্মৃতি হইতে মুছিয়া যায় নাই। সেই লুট হইয়াছিল ব্যাঙ্কের বিভিন্ন পরিষেবার অপব্যবহার করিয়াই। বর্তমান ক্ষেত্রেও তছরুপের পথটি ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ফাঁক গলিয়াই গিয়াছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানিতেও পারে নাই, কী ভাবে অনাদায়ী ঋণের পাহাড় জমিতেছে, এবং ব্যাঙ্ক কর্তারা সমানেই ভুয়া অ্যাকাউন্টের শাকে এই কেলেঙ্কারি ঢাকিতেছেন। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কেমন নজরদারি করে যে এক বার চোর পালাইবার পরেও তাহাদের বুদ্ধি বাড়ে না? কেহ অনুমান করিতেই পারেন যে এই গাফিলতি নেহাত অদক্ষতার ফল নহে, ভিন্নতর কারণ আছে। সেই জল্পনায় প্রবেশ করা অনর্থক, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নজরদারির প্রক্রিয়াটিকে অবিলম্বে স্বচ্ছতর করা বিধেয়। গোড়ায় জানা প্রয়োজন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কোন পরিস্থিতিতে কী করিতে পারে। এবং, পরিস্থিতি অনুসারে ব্যাঙ্ক যথাবিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেছে কি না, সেই তথ্যটিও গণপরিসরে থাকা প্রয়োজন। এ-ক্ষণে যে কথাটি খুবই জোরের সঙ্গে বলা প্রয়োজন, তাহা হইল— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক যদি নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে তাহা ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পক্ষে গভীর চিন্তার কারণ হইবে। কেননা, আর্থিক ব্যবস্থা যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে দাঁড়াইয়া থাকে, গণমানসে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা তাহার রক্ষকের। ব্যাঙ্ক নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হইলে সেই বিশ্বাস ভাঙিবে। সেই ক্ষতি পূরণ হইবার নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement