সবার প্রথমে বলে রাখি প্রবন্ধটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। কোনও অনুমানের ওপর ভরসা না করে, আমাদের সামনে যে তথ্য এসেছে তাকেই ভিত্তি করে অতিমারির গতি দেখার চেষ্টা করেছি। আশা করি, এটিকে একটি তথ্যভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা হিসেবেই গণ্য করতে হবে।যে প্রশ্নটা আজ অসহায় মানুষকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তা হল, ‘আর কত দিন এই করোনার প্রকোপ থাকবে?’ কয়েক মাস যাবৎ আমরা শুধু করোনার বৃদ্ধির প্রভাবই দেখে আসছি।
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আর কত দিন চলবে? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের করোনা তথ্য ও ভারত সরকারের সেরোসার্ভের তথ্যকে যোগ করলে বলা যায়, বিজয়াদশমী এবং কালীপুজোর মাঝে কোনও এক দিন পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ হবে। তার পর রাজ্যে করোনার প্রভাব কমতে আরম্ভ করবে, বড়দিন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা খানিক বেশি দেখা যাবে। কী ভাবে এ কথা বলা যাচ্ছে? আমরা তারই একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি এখানে।
ধরা যাক, এক জন করোনা-আক্রান্তের চার পাশে এমন সবাই আছেন, যাঁদের কখনও করোনা হয়নি, তা হলে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা ও জনসমাজে আক্রান্তের হার দুটোই অনেক বেশি হবে। এবার যদি ছবিটা একটু বদলে এমন হয় যে, এক জন করোনা-সংক্রমিতের চার ধারে যত জন মানুষ রয়েছেন, তার অর্ধেক সংক্রমিত, কিন্তু অনেকেরও সেই সংক্রমণের লক্ষণ নেই, অথবা তাঁরা সদ্য করোনাজয়ী নাগরিক; সে ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা ও হার দুটোই আগের তুলনায় অনেক কম হবে। একই ভাবে যত সময় অতিবাহিত হবে এবং চার ধারের মানুষ উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গের ধারক হবেন বা করোনা জয় করবেন, ততই করোনার বৃদ্ধির হার কমে আসবে।এখানে পাঠক যেন মনে না করেন, প্রচ্ছন্ন ভাবে সংক্রমণের ভবিতব্যকেই স্বীকার করে নিতে বলা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার ও ঘন-ঘন হাত পরিষ্কার যে কোনও সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।
এক চিকিৎসা গবেষণা পত্রিকা, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ, জুলাই-অগস্ট মাসের এক গবেষণাপত্রে প্রকাশ করেছে যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যদি কোনও এক অঞ্চলে এক জনের করোনা হয়েছে বলে আইসিএমআর (ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান অনুসন্ধান পরিষদ)-এর কাছে তথ্য নথিভুক্ত হয়ে থাকে, তা হলে প্রকৃতপক্ষে সেই সংখ্যাটি প্রায় ৮০ বা সর্বোচ্চ ১৩০ পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে। তার কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত করোনা আক্রান্ত নিজের অজানতেই যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তথ্য জানার জন্য তারা দেশের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন তীব্রতার সংক্রমিত এলাকা থেকে ২৮,০০০টি রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কোভিড ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করেছে। ডাক্তারি পরিভাষায় এই পদ্ধতিকে সেরোসার্ভে বলা হয়ে থাকে। এই গবেষণাকর্মে অংশগ্রহণ করেছেন ৪২টি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পঞ্চাশ জনের বেশি ডাক্তার এবং অসংখ্য পরিদর্শকমণ্ডলী।
ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলে বেশি সংখ্যক (১৩০) মৃদু উপসর্গযুক্ত বা উপসর্গহীন মানুষ রয়েছেন, সেখানে আমাদের হিসেব অনুসারে ১৯ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ সংক্রমণ পৌঁছেছিল এবং যে অঞ্চলে কম সংখ্যক (৮০) মৃদু উপসর্গযুক্ত বা উপসর্গহীন মানুষ রয়েছেন, সেখানে আগামী ২৮ অক্টোবর সর্বোচ্চ সংক্রমণ পৌঁছতে পারে। যদি ভারতের সংক্রমণ সূচক ১৩০ ও ৮০-কে মাপকাঠি করে পশ্চিমবঙ্গের জন্য হিসেব করা হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ পর্যায়ের সংক্রমণ থাকতে পারে ২৭ অক্টোবর (বিজয়াদশমী ২৬ অক্টোবর) ও ২৪ ডিসেম্বরের (বড়দিন ২৫ ডিসেম্বর) মধ্যে। তবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ থাকবে সম্ভবত ২৭ অক্টোবর ও ১৮ নভেম্বরের (কালীপুজো ১৪ নভেম্বর) মধ্যে কোনও এক দিন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কোভিডে আমরা যে সহ-নাগরিকদের হারিয়েছি, তাঁদের যোগ করে হিসেব করলে সামগ্রিক ছবিটা বদলাবে না। তথ্য থেকে পাওয়া মৃতের সংখ্যাকে ১৩০ বা ৮০ দিয়ে গুণ করে মোট মৃত্যুর সংখ্যা হিসেব করা ঠিক নয়, অতিমারির বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে অন্য সূচক, ইনফেকশন ফেটালিটি রেশিয়ো বা ‘সংক্রমণ তীব্রতা’, ব্যবহার করে থাকেন।
যাঁরা নিয়মিত আক্রান্তের পরিসংখ্যানের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল, যা ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কমতে শুরু করেছে। যদি এই তারিখ (১৮ সেপ্টেম্বর) ওপরে লেখা সেরোসার্ভের তথ্য থেকে নির্ধারিত সময়ের (১৯ সেপ্টেম্বর) সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা হলে বলা যায় সব হিসেব প্রায় মিলেই গেল। কিন্তু না, ঠিক তা নয়। তার কারণ, সেরোসার্ভের তথ্য থেকে নির্ধারিত সময়ের হিসেব করার মূল সমস্যা হল সেখানে মাত্র ২৮,০০০টি নমুনা ব্যবহার করা হয়েছে। আর একটি বড় সমস্যা হল, আমরা মে মাসে করা সেরোসার্ভের তথ্য সব ক’টি মাসের জন্য ব্যবহার করেছি। এখন যেহেতু আমাদের কাছে ওই একটি সেরোসার্ভের তথ্যই অন্ধের যষ্টি, তাই কোনও উপায় নেই।
কিন্তু আইসিএমআর-এর প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, তারা আরও ব্যাপক আকারে এই সেরোসার্ভের পরিকল্পনা করছে। আমরা তাকিয়ে থাকব যাতে অনুরূপ গবেষণাপত্র স্বল্প উপসর্গযুক্ত ও উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তের একটি রাজ্যভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা শুধু সর্বোচ্চ সংক্রমণ নয়, অতিমারি কবে শেষ হবে, তারও একটা স্পষ্ট, বিজ্ঞানসম্মত রাজ্যভিত্তিক চিত্র দেখতে পাব।
লেখক: প্রাক্তন রামানুজন ফেলো, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স; প্রাক্তন অধিকর্তা, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার