সমাজতন্ত্রের ওষুধই ভরসা?
Coronavirus

করোনাভাইরাস বিধ্বস্ত ধনতান্ত্রিক দুনিয়া আজ কী বার্তা পাচ্ছে

এরই মাঝে করোনাভাইরাস-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় কি বইছে সমাজতন্ত্রের নতুন ফল্গুস্রোত?

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২০ ০১:০০
Share:

মুখাপেক্ষী: সরকারি বেকার-সহায়তার খাতায় নাম লেখানোর জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা, কেন্টাকি, ১৯ জুন। ছবি: এএফপি

আমাদের সময়ের ক্রম ঠিক করার ‘খ্রিস্টাব্দ’ আর ‘খ্রিস্টপূর্বাব্দ’-এর প্রচলিত ছক ভেঙে তৈরি করা যেতেই পারে নতুন ছক— ‘বিসি’ অর্থাৎ ‘বিফোর করোনা’, এবং ‘এসি’ অর্থাৎ ‘আফটার করোনা’, বলেছেন পুলিৎজ়ার-বিজয়ী লেখক ও সাংবাদিক টমাস ফ্রিডম্যান। গোটা দুনিয়াই আজ ওলট-পালট হবার উপক্রম। শোনা গিয়েছে, বিভিন্ন দেশের জিডিপি কমে যাবে ৮-১০%, বা আরও বেশি। ধাক্কা খাবে গ্লোবালাইজ়েশনের প্রচলিত ধারণা। বদলে যাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, গ্লোবাল সাপ্লাই চেনের মডেল। জোরদার হবে উৎপাদন ও সরবরাহের স্থানীয়করণের প্রবণতা। বদলে যাবে এ গ্রহের রাজনীতিও। পাল্টাবে সুরক্ষা বা ভাল থাকার সংজ্ঞা। শিক্ষালয়ের প্রচলিত ধ্যানধারণা। চাকরি হারাবে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ। তছনছ হয়ে যাবে স্বনিযুক্ত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের জীবিকাও।

Advertisement

এরই মাঝে করোনাভাইরাস-বিধ্বস্ত দুনিয়ায় কি বইছে সমাজতন্ত্রের নতুন ফল্গুস্রোত? পৃথিবীর অনেকটা অংশ এমনিতেই ধনতান্ত্রিক। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার জন্মজন্মান্তরের আড়ি। মজার কথা হল, অতিমারি-বিধ্বস্ত এই চূড়ান্ত দুর্দিনে দেখা যাচ্ছে সবাই কিন্তু কমবেশি সোশ্যালিস্ট হওয়ার চেষ্টায়। আমেরিকায় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের সরকার পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে জনপিছু দিল ২,০০০ ডলার, বাড়াল গরিবদের পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য ‘সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’-এর সুবিধা, ঘোষণা হল ক্ষুদ্র ব্যবসায় জরুরি ভিত্তিতে ঋণদানের। এ সব তো ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ বা ইউবিআই-এরই একটা রূপ। সে দেশে এত দিন ‘ইউবিআই’ নিয়ে সওয়াল করেছেন আলেকজান্দ্রিয়া অকাসিও-কর্তেজের মত ডেমোক্র্যাট নেতারা, আর তার আংশিক বাস্তবায়ন করে ফেললেন রিপাবলিকান ট্রাম্প! অবশ্য নির্বাচনের বছর না হলে প্যাকেজটা কী দাঁড়াত কে জানে।

আমেরিকায় নিয়মিত ঘণ্টা-পিছু কর্মীদের সবেতন ‘সিক লিভ’ দেওয়ার ঘোষণা করেছে বিভিন্ন কোম্পানি। যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে সামাজিক সুরক্ষা কাটছাঁট করতে চেয়েছেন, আজ স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরের লোকদের বিনা খরচে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা এবং চিকিৎসার পক্ষে তাঁরা। অবশ্যই নিজের স্বার্থেই।

Advertisement

কানাডায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর মুখেও সমাজতন্ত্রের সুর। ট্রুডো সরকার প্রথমেই ১০৭ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার ঘোষণা করেছিল করোনা মোকাবিলায়, যা কানাডার জিডিপি-র ৩%-এর চাইতেও বেশি। কর্মীদের এবং ব্যবসাকে সরাসরি সহায়তা ছাড়াও করোনার প্রভাবে চাকরি যাওয়া রুখতে কর্মীদের মাইনের ১০%-এর জোগান দেবে সরকার। কর্মীদের জন্য বড়সড় প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স। কর্মীদের চাকরি যাওয়া আটকাতে সর্বাধিক ২,৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত প্রত্যেকের মাইনের ৮০% দেবে ব্রিটিশ সরকার। কনজ়ারভেটিভ নেতা বরিস জনসনের কার্যকালে সরকারি সাহায্যে এই বিশাল বহর কিন্তু হেলাফেলার বিষয় নয়। লেবার নেতা জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রী হলেও এর চেয়ে খুব বেশি হত না।

ডেনমার্কের কোনও কোম্পানির ৩০% অথবা ৫০ জন কর্মী ছাঁটাইয়ের অবস্থা হলে তিন মাস তাদের মাইনের তিন-চতুর্থাংশ সরকারই জোগাবে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার ৬,৯০,০০০ ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ৭৮ লক্ষ কর্মীর সুরক্ষায় দিয়েছে ৬.৭ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে ‘সীমাহীন’ ঋণদানের ঘোষণা করেছে জার্মানি। সামাজিক সুরক্ষায় ২০০ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে স্পেন, যা তাদের জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। অনেকটা ইটালি আর ফ্রান্সের ধাঁচে। সামাজিক ঢাল হয়ে উঠেছে রক্ষাকবচ, যাতে সমাজতন্ত্রের হলদে পালকের ছাপ। ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিকে জোগাচ্ছে ঋণ। ছাত্রঋণ শোধ আর ট্যাক্স জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে দেশে দেশে।

ভারতের কাঠামোটা এমনিতেই খুব ধনতান্ত্রিক নয়। কেন্দ্রের প্যাকেজ ছাড়াও রাজ্যে রাজ্যে পেনশন-সুবিধাভোগীদের অগ্রিম পেনশন, কোথাও পেনশনের আওতার বাইরের পরিবারগুলিকে, কোথাও আবার নির্মাণকর্মীদের, ছোটখাটো স্বনিযুক্তদের অর্থসাহায্য, অভাবী পরিবারগুলিকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, ভর্তুকিযুক্ত খাবার, ফ্রি রেশন, দ্বিগুণ পেনশন, স্বাস্থ্যকর্মীদের বিমা, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে একই সুর প্রায় সর্বত্র। যেন খানিকটা কেন্সের শতাব্দী-প্রাচীন ফিসকাল উদ্দীপনার সেই তত্ত্ব, যা বলে, অর্থনীতির বিপর্যয়ের সময়ে সরকার অর্থের জোগান দিলে, তা শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলবে ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ, বাড়বে ব্যয়। ব্যয় চাগিয়ে তুলবে সামগ্রিক উৎপাদন, প্রশস্ত করবে আরও আয়ের পথ। কিন্তু বিপর্যয়ের এই সময়ে, বিশ্ব জুড়ে লকডাউন আর মন্দার প্রেক্ষিতে সাহায্যের টাকায় ভোগ্যপণ্য কিনবে জনতা, আর সে কারণে ব্যবসাবাণিজ্যে উদ্দীপনা এসে উৎপাদন বাড়বে, সে সম্ভাবনা অল্পই। তবু শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম সঙ্কটের আবর্তে টালমাটাল দুনিয়া আঁকড়ে ধরেছে সমাজতন্ত্রের প্রচলিত পদ্ধতি।

গল্প এখানেই শেষ নয়। ধনতন্ত্রকে তো মার্কিন দেশের ধর্মই বলা চলে। সুতরাং অতিমারির মৃত্যুমিছিলের মধ্যেই তা আবার মাথা তুলছে তেড়েফুঁড়ে। করোনার সন্ত্রাসে অর্থনীতি যতই কুঁকড়ে যাবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনায় ধাক্কা লাগবে ততটাই। করোনা-বিধ্বস্ত আমেরিকায় জনগণের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার চাইতেও অর্থনীতিই তাই অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে। সরকার এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি জোগান দিচ্ছে বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। মার্কিন বিমান সংস্থাগুলিকে। বড় হোটেল, রেস্তরাঁগুলিকে। রয়্যাল ক্যারিবিয়ান কিংবা কার্নিভালের মত ক্রুজ়লাইনকে। বিমান তৈরি, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কোম্পানিগুলিকে। শেয়ার বাজারের ‘বুল-রান’ বজায় রাখতে, সূচক ‘ডাও জোন্স’-এর স্বার্থে জনস্বাস্থ্যের কথা ভুলে জনগণকে কাজে ফিরতে পরামর্শ দিয়েছেন রাজনীতিবিদরা। জোর কদমে প্রচার চলেছে— ‘ডাই ফর দ্য ডাও’। মার্কিন অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে, বয়স্ক আমেরিকানদের ভাইরাসে মরার ঝুঁকিও নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন রিপাবলিকান নেতারা। প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। মানুষের জীবনের দাম ডলারে নির্ধারণ করা যায় কি না, এই বিতর্কের মধ্য দিয়েই ধনতান্ত্রিক দেশের চিরন্তন রাজনৈতিক তরজা প্রবল হয়ে উঠছে।

করোনাভাইরাসের প্রতিরোধে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কাল যতই প্রকট হবে, আরও জোরদার আওয়াজ উঠবে এককালীন অনুদানে চিকিৎসা পরিষেবা এবং ওবামাকেয়ারের সপক্ষে। সামাজিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এই বিষয়গুলো যে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় বিষয় হতে চলেছে, সে এক প্রকার নিশ্চিত। ‘করোনা’ মার্কিন সমাজের কাঠামোকে বদলানোর মতো প্রবল ধাক্কা দিতে না পারলেও আগামী দিনে, বিশেষত ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসলে, একটা আলগা সমাজতান্ত্রিক প্রলেপের মানসিক প্রস্তুতি হয়েই রইল মার্কিন জনতার। ইতিমধ্যেই দাবি জোরদার হতে শুরু করেছে নিখরচায় স্বাস্থ্য-পরিষেবা, সবেতন ‘সিক লিভ’, স্থিতিশীল বাড়িভাড়া, অবশ্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবা হয় রাষ্ট্রের মালিকানাধীন করার অথবা ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ বাধ্যতামূলক ভাবে যুক্তিসঙ্গত মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করার।

করোনা-উত্তর সময়কালে অর্থাৎ ফ্রিডম্যান-বর্ণিত ‘এসি’-তে পৃথিবী কি হয়ে উঠবে অনেকটাই সমাজতান্ত্রিক? না কি, দুনিয়া ফিরে যাবে তার পুরনো ছন্দে, পুরনো দ্বন্দ্বে? কে জানে হয়তো ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের চিরায়ত সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব খুঁজে পাবে এক নতুন রেফারেন্স-বিন্দু।

মনে থাকবে, প্রলয়-সন্ধ্যায় ধনতন্ত্রের উপাসকদেরও বাধ্য হয়ে খানিকটা গিলতে হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক ওষুধ’। ‘ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারার’-এর সাংবাদিক-লেখক উইল বাঞ্চ এর নাম দিয়েছেন ‘ডিজ়াস্টার সোশ্যালিজ়ম’ বা ‘বিপর্যয়-কালীন সমাজতন্ত্র’, স্পর্ধিত ধনতন্ত্রকে যা কঠিন জিজ্ঞাসার মুখে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ দুর্যোগের অশনিসঙ্কেতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement