নারী-শরীর নিয়ে অপরাধবোধ

আসলে, ‘শ্যাম রাখি না কুল’-এর দ্বন্দ্ব মেটাতে অবস্থান বদল করা ছাড়া গতিও নেই।

Advertisement

অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

প্রতি দিন নতুন ঘটনা, তাই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও পুরনো হয়ে হারাতে বসে বড্ড তাড়াতাড়ি। এ দিকে এই নভেম্বর মাসে শবরীমালা মন্দির কিন্তু আবার গণমাধ্যমের শিরোনামে ফেরত এসেছিল। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের রায়ে শবরীমালা মন্দিরের ঋতুযোগ্য মেয়েদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞাকে অসাংবিধানিক এবং বৈষম্যমূলক আখ্যা দেন। তার পর থেকেই চলছিল আন্দোলন, বিতর্ক, অশান্তি। কেরলের বাম সরকার রায় কার্যকর করতে সচেষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অশান্তি অব্যাহত থাকে। এই প্রেক্ষাপটে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি সর্বোচ্চ আদালতের কাছে গৃহীত হয়। ১৪ নভেম্বর ২০১৯ সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বিবেচিত রায় জানানোর পরিবর্তে গত বছরের রায় বহাল রেখে সেই আর্জি সাত বিচারপতির বেঞ্চের কাছে পাঠিয়েছেন। এরই মধ্যে ১৬ নভেম্বর ২০১৯ থেকে আগামী ৪০ দিনব্যাপী বার্ষিক তীর্থযাত্রার জন্যে মন্দিরের প্রবেশদ্বার ভক্তদের উদ্দেশে খুলে গিয়েছে। লক্ষণীয়, এ বছর সরকার আগের অবস্থান বদল করে ফেলেছে। মন্দিরে ঋতুযোগ্য বয়সের কোনও মহিলার প্রবেশের ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসন সহযোগিতা তো করছেই না, বরং তারাই মহিলা তীর্থযাত্রীদের মন্দিরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। উপরন্তু ঘোষণা করা হয়েছে, যদি কোনও মহিলা মন্দিরে প্রবেশ করার জন্যে পুলিশি নিরাপত্তার প্রয়োজন বোধ করেন, তা হলে তাঁকে আদালতে গিয়ে নির্দেশ নিয়ে আসতে হবে।

Advertisement

আসলে, ‘শ্যাম রাখি না কুল’-এর দ্বন্দ্ব মেটাতে অবস্থান বদল করা ছাড়া গতিও নেই। মূলস্রোতের যে দলীয় রাজনীতির ময়দানে বামপন্থী দলগুলি বিচরণ করে এবং অন্যান্য প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে অহরহ টক্কর দিয়ে টিকে থাকে সেই রাজনীতির আদত চরিত্রটি তো পুরুষতান্ত্রিক। আর সেই পুরুষতন্ত্রের অতি প্রাচীন এবং বিশ্বস্ত হাতিয়ার হল ধর্ম। কাজেই ধর্ম বিষয়ে তাত্ত্বিক অবস্থান বামপন্থীদের যা-ই হোক না কেন, ভারতীয় দলীয় রাজনীতিতে থেকে ক্ষমতা দখল ও ভোগ করতে হলে ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে তাদেরও হাতে হাত মিলিয়েই চলতে হবে।

এ পর্যন্ত তবু হিসেবনিকেশ এক প্রকার বোঝা যায়। কিন্তু যে মহিলারা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তাঁদের বুঝতে আপাত ভাবে একটু অসুবিধে হয় বইকি। ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মাসের যে-দিনগুলিতে তাঁদের রক্তস্রাব চলে সেই দিনগুলিতে তাঁদের শরীর অশুচি ও অপবিত্র থাকে। হয়তো তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে আত্মস্থ করেছেন এমন ভাবেই।

Advertisement

এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সামনে এসে পড়ে নারীদেহের ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ন্ত্রণ এবং নারীর নিজের দেহের ওপর অধিকারহীনতার প্রশ্নটি। নারী নিজের দেহের ওপর অধিকার দাবি করতে যাতে না পারেন, তাই নিঃসাড়ে সুকৌশলে জন্মের পর থেকেই নারীর মননে পুঁতে দেওয়া হয় নিজের দেহের প্রতি ঘৃণাবোধক অনুভূতির বীজ। নিজের দেহকে, নিজের দৈহিক অনুভূতিকে উদ্‌যাপন করার বদলে, সেগুলিকে ঘিরে আনন্দবোধ করার বদলে ছোট বয়স থেকেই তার মধ্যে নিজের শরীর নিয়ে গা-ঘিনঘিনে একটা বোধ চারিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক আচারের মধ্যে দিয়ে।

এর পর কাজটা হয়ে যায় সহজ। নারী নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেন যদি তিনি কোনও ‘দুর্বল’ মুহূর্তে একান্তে লোকচক্ষুর আড়ালেও নিজের দেহকে ভালবেসে ফেলেন, দৈহিক সুখ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। সুতরাং তাঁর নিজের শরীরের ওপর তাঁর নিজের অধিকার দাবি করার কথা তিনি আর ভাবতেই পারেন না। সেই অধিকার দাবি করার সাহস যাঁরা দেখান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁদের নামতে হয় সম্মুখসমরে। সেই লড়াইয়ের ফলে এক দিকে যেমন পাওয়া যায় গর্ভপাতের আইনি অধিকার, প্রজননক্ষম থাকাকালীন মন্দিরে প্রবেশাধিকার বা সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি, বা নবতম সাফল্য ‘পিরিয়ড লিভ’, তেমনই তার সঙ্গে জোটে সহনাগরিক, সহকর্মীদের কাছ থেকে গঞ্জনা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, টিটকিরি— ‘সুবিধাভোগী’র তকমা, অধিকার লাভের ন্যায্যতা নিয়ে নানা বিতর্ক।

পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করেন যে সব মহিলা তাঁরা মনে করেন পুরুষতন্ত্রের হয়ে কাজ করলে ‘সাফল্য’ অর্জন করবেন সহজে। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি এই মহিলাদের স্বরকে সামনে রেখে রাজনীতি করেন। পুরুষতান্ত্রিক (মনোভাবাপন্ন) মহিলাদের সামনে রেখে রাষ্ট্রের সুবিধে হয় নারীর স্বাধিকারের স্বরকে নীরব করতে, প্রান্তিক করে দিতে। নারী মানেই তো স্বাধিকার-সচেতন ব্যক্তি নন— এই বাস্তবতাকে কাজে লাগানো হয় নারীবাদী স্বাধিকার-সচেতন দাবিকে নস্যাৎ করতে। আসল কথা, নারী, পুরুষ, বা তৃতীয় লিঙ্গ, এ সবই পুরুষতন্ত্রের নির্মাণ, বাস্তবিক ‘লিঙ্গ’ নামক সামাজিক বর্গটাই পুরুষতন্ত্রের অবদান, এই সত্যিটা সামনে রাখলেই হয়তো নারীর ব্যক্তিস্বাধিকারের প্রশ্ন এবং সেই বিষয়ক সচেতনতা একটা অন্য মাত্রা পেতে পারে।

দর্শন বিভাগ, টাকি গভর্নমেন্ট কলেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement