এরোড্রামের হাইড্রেনে পড়ে মৃত হলদে গোসাপ (বাঁ দিকে)। জালে আটকে পড়েছে মাছরাঙা (মাঝে)। গাড়ি চাপা পড়ে মৃত কালাচ (ডান দিকে)। ছবি সৌজন্যে: https://www.wildlifeday.org।
স্মৃতির পাতায় কিছু ছবি ভেসে ওঠে। হাইস্কুলে যাওয়ার সময় ‘শর্টকাট’ করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই মাঝিপাড়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরতাম। মাঝেমধ্যে উৎসুক দৃষ্টিতে কুঁড়ে ঘরগুলির পাশে চোখ রেখে মাঝিদের বিয়ে বা অন্য লোকাচার দেখেছি। এর মধ্যে একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘শিকার উৎসব’। কিন্তু কোনও দিন সাহস করে সামনে যেতে পারিনি।
সবে ‘আরণ্যক’ পড়েছি, তাই প্রায়ই ‘টাঁড়বারো’র ভয় বুকে দানা বাঁধত। জঙ্গল, সাঁওতাল আর ঘেঁটুফুলের গন্ধ একাকার হতে হতে মাঝে মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতায় আচ্ছন্ন হত মন। এমন সব কথা ভাবতে ভাবতে যখন দলছুট হয়ে ওই গলি দিয়ে একা বাড়ি ফিরতাম তখন মাঝে মধ্যে সাক্ষাৎ হত মহিষের দলের সঙ্গে। ভাবতাম গল্পের ‘টাঁড়বারো’ জীবন্ত হয়ে রূপ নিয়ে এল বুঝি। কিন্তু বুড়ো গোয়ালাদাদুর হাসিতে ঘোর কাটত। পাশের বাড়ির দাদার কাছে শুনেছিলাম মাঝিরা নাকি দল বেঁধে ‘শিঙারণ’-এর ধার থেকে গোসাপ, খটাশ, ভাম শিকার করে।
তবে শুধু আমাদের জেলাতেই নয়, ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রায় সর্বত্র শিকারের রীতি প্রচলিত রয়েছে। অনেকে এই শিকার কেন্দ্রিক উৎসবকে লোকসংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গও বলে থাকেন। তবে লোক উৎসবের পাশাপাশি, ভারতীয় ভূখণ্ডে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শিকার করা একটা শখ হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। অনেকেই নিছক বিনোদনের জন্য হাজার হাজার বাঘ ও পাখি হত্যা করেছেন। ব্রিটিশ আমলের একটা সময় পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন স্থানের জঙ্গলগুলি ছিল তৎকালীন দেশীয় রাজা মহারাজা এবং ব্রিটিশ শাসকদের অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র। যথেচ্ছ হারে শিকার করার জেরে আজ বন্যপ্রাণ বিপন্ন। তাই আমরা আজ পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের খেসারত দিতে শুরু করেছি।
পরিসংখ্যান বলছে, একের পরে এক প্রজাতির প্রাণী নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতিরও অস্তিত্ব বিপন্ন। সভ্যতার মেকি উন্নয়নের যে রাজসূয় যজ্ঞে আমরা ব্রতী হয়েছি, তার বলি হচ্ছে শতশত নিরীহ বন্যপ্রাণী। জল-জঙ্গল সর্বত্রই সভ্যতার অস্তিত্ব বিস্তার করতে উদ্যত মানুষ ভুলতে বসেছে বিবর্তনবাদ আর বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক সূত্রগুলি। এ ভাবে চলতে থাকলে সে দিন আর বেশি দূরে নেই যখন ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ একটি সঙ্কটাপন্ন প্রজাতি হিসাবে পরিগণিত হবে।
যাঁরা উন্নয়নের নেশায় আত্মমগ্ন তাদের কাছে এই সব কথা অবান্তর। কিন্তু আমাদের পৃথিবী আজ কতটা ভারাক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত তা বোঝা যাচ্ছে একের পরে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের বহর ও তীব্রতা দেখেই। নিজেদের রক্ষার্থে মানুষকে রক্ষা করতে হবে অরণ্য এবং আরণ্যকদের। তাই সময় হয়েছে জেগে ওঠার, যাঁরা ঘুমের ভান করে জেগে রয়েছেন তাঁদের সচেতন করার।
রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা আবর্জনা ফেলার বাক্সে যেমন লিখে রাখতে হয় ‘আমাকে ব্যবহার করো’ তেমনই আজ বিভিন্ন সন্মেলন, বিশেষ দিন পালন আর পদযাত্রার মত আনুষ্ঠানিক কর্মসূচির মাধ্যমে জানান দিতে হচ্ছে আমরা কতটা বিপদের মধ্যে আছি। পরিবেশে জল-বায়ু-মাটি প্রভৃতি মৌলিক উপাদানগুলি যেমন আমাদের অত্যাবশ্যক তেমনই প্রয়োজন বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি ‘ফ্লোরা’ ও ‘ফনা’র সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান।
উদ্ভিদভোজীদের স্বার্থে যেমন থাকতে হবে উদ্ভিদকে তেমনই মাংসভোজীদের স্বার্থে উদ্ভিদভোজীদের। কিন্তু বর্তমানে আমাদের বেহিসেবি লোভের বলি হতে হতে বন্যপ্রাণীরা আজ বিপন্ন। আর তাই এ কথা মাথায় রেখে শুরু হয় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দিবস’ পালন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩ তারিখে ৩ মার্চ দিনটিকে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণ দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব পেশ করে। যার উদ্দেশ্য ছিল ,সাধারণ মানুষকে বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকুলের প্রতি সচেতন করে তোলা। এর পরে ওই বছরেই ৩-১৪ মার্চ তাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে আয়োজিত আন্তৰ্জাতিক বিলুপ্তপ্ৰায় বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের বাণিজ্য সম্মেলনে (সিআইটিইএস) রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ৩ মার্চ দিনটিকে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিআইটিইএস নিশ্চিত করে যে আন্তৰ্জাতিক বাণিজ্যের প্রভাব যাতে বন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর টিকে থাকায় আশঙ্কার সৃষ্টি না করে সে দিকে নজর রাখা হবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রেজোলিউশনে এই বিবৃতি দেওয়া হয় যে, ‘মানবকল্যাণে বন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অপরিহার্য মূল্যের কথা মাথায় রেখে উভয়ের যুগ্ম উন্নোয়নের দিকগুলি উন্মোচিত করাই হবে এই বিশেষ দিবস পালনের লক্ষ্য’। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর একটি সুনির্দিষ্ট প্রসঙ্গ বা বিষয় নির্ধারণ করে সে বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রায় সব ক’টি সদস্য দেশে। প্রচলিত বিবর্তনবাদ অনুসারে, সমুদ্র থেকেই প্রাণের বিকাশের শুরু, এমনকি, পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণের বিচরণ অতল জলের তলে। তাই ২০১৯ সালে বন্যপ্রাণী দিবসের বিষয় ছিল জলের নীচের জীবনকে রক্ষার মাধ্যমে মানুষ এবং পৃথিবীকে রক্ষা করা। আমরা জানি, বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ আর বর্জ্য পদার্থ এবং তেল মিশে সামুদ্রিক জীবদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই পৃথিবীকে রক্ষা করতে এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা।
২০২০ সালের ৩ মার্চ ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ এর মূল ‘থিম’— ‘পৃথিবীতে সমস্ত জীবন বজায় রাখা’। পরিবেশবিদেরা জানান, বৈচিত্রময় এই পৃথিবীর জীবসম্ভারকে টিকিয়ে রাখতে হলে দারিদ্র দূরীকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং সমগ্র জীবকূলকে বিশেষ সংরক্ষণের পরিবেষ্টনে বাঁধতে হবে। বিপদগ্রস্ত তালিকায় পড়ে এমন জীবদের সঠিক সুরক্ষা প্রদান করাও আমাদের দায়িত্ব। বিশ্ব জুড়ে বন্যপ্রাণীদের উপরে ঘটে চলা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন প্রণয়ন করাকেও দায়িত্ব হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে। সর্বোপরি, জনসাধারণের মধ্যে সংরক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরা। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্র এই বিষয়ে সচেতনতা পালিত হচ্ছে।
তবে এত কিছুর পরেও রক্ষা করা যাচ্ছে না অরণ্য সম্পদকে। আগ্রাসনের কবলে পড়ে বিপন্ন বাস্তুতন্ত্র। শুধু আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া বা প্রাকৃতিক খাদ্যাভাব নয়, বিভিন্ন উপায়ে আমাদের চোখের সামনে নষ্ট করা হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। ঘটে চলেছে বিভিন্ন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুকুরে মাছরাঙা বা বকের থেকে মাছ বাঁচাতে ব্যবহৃত হচ্ছে নাইলনের জাল। ক্ষেতে শস্য ফলন বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে বেশি পরিমাণ কীটনাশক। তা ছাড়া, প্রতি বছর যে সব পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে আসে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে মাংসের লোভে। কোথাও ব্যবহার হচ্ছে বন্দুক, তো কোথাও বিষ ইঞ্জেকশন। বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাংসাশী পাখিদের খাদ্যে। আর সেই খেয়ে অসাড় হয়ে পড়ছে এরা, তার পরে সহজে শিকার করা হচ্ছে। এক দল মানুষ এখনও মাঠে ঘাটে ওৎ পেতে থাকে বনমোরগ, তিতির বা খরগোশের খোঁজে। এরা পেতে রাখে মরণফাঁদ— ‘আড়ি-জাল’। তাই মুষ্টিমেয় স্বেচ্ছাসেবী বা অরণ্যপ্রেমী সংগঠন নয়, সমাজের সর্ব স্তরে পালন করতে হবে এই দিন। বিদ্যালয়ে পালন করতে হবে বিশেষ অনুষ্ঠান। তারই মাধ্যমে শিশুমনে গড়ে উঠবে বন্যপ্রাণ প্রীতি আর সফল হবে নবজাতকের কাছে করা আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক সিয়ারশোল নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের শিক্ষক