গীতাভক্ত গাঁধীর মতে, ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় অবদান হল অহিংসার তত্ত্ব।’ অর্থাৎ, অহিংসা শুধু অসহযোগ বা অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি ব্যবহারিক অস্ত্র নয়, অহিংসা একটি সর্বজনীন নৈতিক সত্য এবং সেটি হিন্দুধর্মের ওপর আধারিত।
এখানেই সমস্যা বাধে। চৌরিচৌরাতে আন্দোলনকারী ভারতীয়দের হাতে কয়েক জন পুলিশের মৃত্যু হল বলে, তিনি আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী ওই আন্দোলন তুলে নিলেন, যে-আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তিনি নিজে। তার মানে এখানে মূর্ত রাজনীতির ঊর্ধে স্থান পেল বিমূর্ত, সর্বজনীন নীতিশাস্ত্র। স্বাধীনতা-আন্দোলনের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াল অহিংসার তত্ত্ব। পরিণাম, ব্রিটিশ শাসকদের শক্তিবৃদ্ধি। গাঁধীজি রাজনীতির মানুষ না হলে এটা তাঁর ব্যক্তিগত নীতি-সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সন্ত গাঁধী তো স্মরণীয় ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ গাঁধী হিসেবেই। অথচ পরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন কি তাঁর এই অহিংসা-তত্ত্বর সমাধির ওপরেই সার্থকতা লাভ করেনি? তা হলে রাজনীতির অঙ্গনে কোথায় রইল তাঁর অহিংসা-তত্ত্বর প্রয়োগসার্থকতা?
যারা বলে, সহিংস যুদ্ধই ক্ষত্রিয়দের স্বধর্ম আর স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরোধর্ম ভয়াবহ, তারা কী করে অহিংসার পরাকাষ্ঠা হতে পারে, এই স্ববিরোধিতা অনেককেই ভাবিয়েছে। সুদূর ১৮৭০ সালে অক্ষয়কুমার দত্ত বলেছিলেন, গীতার মর্মবাণী হল, আত্মা মরে না, সুতরাং যত খুশি মানুষ খুন করলে কোনও পাপ নেই। বিদ্যাসাগর জীবনে কখনও গীতার কথা বলেননি। আকাশ থেকে বোমা ফেলে মাটির মানুষ নিধন করার নির্বিকার-চিত্ত সাফল্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়োজাহাজ – অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর।... সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’। গাঁধী অবশ্য বলবেন, অনেকেই বলেন, গীতাকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার কোনও দরকারই নেই, ওর সবটাই রূপক।
পুরনো কালের এবং এ কালের পণ্ডিতরা অনেকেই হিন্দুধর্মর এই অহিংসাবাদী ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। যেমন সিলভ্যাঁ লেভি। তিনি বৈদিক মতাদর্শকে ‘নৃশংস’ এবং ‘জড়বাদী’ বলেছিলেন। এ তথ্য দিয়ে এ কালের পণ্ডিত ওয়েন্ডি ডনিগার বলেছেন, খাদ্য-খাদক শৃঙ্খলের ‘ধারণাসূত্রটি’ আগাগোড়া প্রবাহিত হয়েছে বেদের মধ্য দিয়ে— একদল খায়, আর একদল ভুক্ত হয়। এখানে অহিংসার স্থান কোথায়? ডনিগারের মতে, ক্ষমতা আর হিংসার জয়গান গাওয়া হয়েছে বেদ জুড়ে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, রণ-রক্ত-সফলতার মহাকাব্য মহাভারতে ‘অহিংসা’কে মহত্তম সত্য আর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা বলা হয়েছে, যে-মহাভারতের অঙ্গ আবার গীতা, যা অনেকের মতে প্রক্ষিপ্ত। এখানে ডনিগারের ব্যাখ্যা হল, অহিংসার কথা এত বেশি করে বলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই জন্যই যে, হিংসার প্রকোপ ছিল ব্যাপক। যেমন বাইবেলে বার বার করে বলা হয়েছে, চুরি কোরো না, প্রতিবেশীর স্ত্রীর প্রতি কুনজর দিয়ো না। তার অর্থ, ওই কর্ম দুটির প্রাদুর্ভাব সে সময়ে খুবই প্রবল ছিল। অহিংসার ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।
ডনিগার আরও একটা ভাববার মতো কথা বলেছেন। গোড়ার দিকে হিন্দু সমাজে অহিংসার প্রশ্নটা সীমাবদ্ধ ছিল মাংস খাওয়া আর পশু বলিদানের মধ্যে। কিন্তু ক্রমে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিতর্কেও ঢুকে পড়ল সে-প্রশ্ন। তখন একই সঙ্গে পশুদের প্রতি হিংসা আর ‘পশু-প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত পারিয়াদের’ প্রতি হিংসার প্রসঙ্গও উঠে পড়ল। আর সেখান থেকে অবধারিত ভাবেই এল ‘মানুষে-মানুষে হিংসার প্রসঙ্গ, কেননা মানুষও তো পশু, আর পশুরা হিংস্র।’ সুতরাং, ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় অবদান হল অহিংসার তত্ত্ব’, বাস্তব অনুশীলন থেকে গাঁধীর এ-ধারণার বিশেষ সমর্থন মেলে না। হিন্দুধর্মে হিংসাটাই বাস্তব, অহিংসাটা ঈপ্সা।
একেবারে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে অম্বেডকরের সমালোচনা স্মরণীয়। ঈষৎ শ্লেষের সুরে তিনি বলেছিলেন, গাঁধী ‘রাজনীতিকে সাত্ত্বিক বানাতে চাইছেন, কারণ তিনি যে মহাত্মা।’ কিন্তু রাজনীতিতে তিনি সফল হোন বা না-হোন, রাজনীতি তাঁকে ‘বাণিজ্যীভূত’ করে ফেলেছে, সাত্ত্বিক থাকতে দেয়নি। তিনি জেনে গেছেন, পুরো সত্যিটা বলতে নেই। কী সেই পুরো সত্য? অম্বেডকর বলছেন, বর্ণাশ্রমের ভিত্তিই হল হিংসা, অথচ গাঁধীজি বর্ণাশ্রমের সমর্থক, কারণ তাঁর ভয়, ওর বিরোধিতা করলে ‘রাজনীতিক্ষেত্রে তিনি নিজের স্থান হারাবেন’, কেননা সেই ক্ষেত্রটি বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদপন্থী হিন্দুতে ঠাসা। সত্য ও অহিংসার পূজারী হলেও, সে-হিংসাকে মেনে নিতে মহাত্মার অসুবিধা নেই। মহাত্মা বলেন, তাঁর অহিংসা-অস্ত্রের প্রয়োগেই তিনি উপনিবেশবাদীদের হার মানাবেন। অহিংসা-অস্ত্রের শক্তিতে যদি তাঁর এতই আস্থা, তা হলে সবার আগে হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে সে-অস্ত্র প্রয়োগ করছেন না কেন? অম্বেডকরের মতে, অহিংসা তত্ত্বর উপলব্ধিতে রাজনীতিবিদ গাঁধী আর ‘মহাত্মা’ গাঁধীর মধ্যে অনেক তফাত। তা ছাড়া অম্বেডকরের সাফ কথা, সাত্ত্বিক ঋষিরা জীবনে কোনও দিন জাতিভেদ কিংবা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। কাজেই ‘ঋষিদের ওপর ভরসা রাখলে কোনও দিনই সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে না।’ রাজনীতিকে সাত্ত্বিক করে তোলা কোনও কাজের কথা নয়।
অহিংসা তত্ত্বর উপলব্ধিতে রাজনীতিবিদ গাঁধী আর ‘মহাত্মা’ গাঁধীর মধ্যে অনেক তফাত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
এ প্রসঙ্গে ১৯৩৬ সালে মহাদেব দেশাইকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি মর্মভেদী: ‘ব্যাপক জনসাধারণের উপর মহাত্মাজীর যে-প্রভাব তা সত্যিই বিপুল, তা সত্যিই আমাদের মধ্যে জাগরণ এনেছে। তবু আমি জানি না, আরও কত দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাঁর শিক্ষা আমাদের মাটির গভীর অন্ধকারে প্রোথিত বিষাক্ত শিকড়গুলির উপর ঠিকমতো কাজ করতে পারবে। অথচ আমরা জানি, অমঙ্গলের কণ্টকাকীর্ণ পথে পথে ছড়িয়ে-থাকা বিপর্যয় কখনো দিনক্ষণ মেনে আসে না; কবে আমরা তার নিরাময় ঘটাতে পারব, সেই হিসেব করে তো বিপর্যয় আসে না। যে-ওষুধ রোগ সারাতে অতিরিক্ত সময় নেয়, প্রায়শ সে-ওষুধ ধরবার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়।’
অহিংসা তত্ত্বর মহত্ত্বর কথা বলতে গিয়ে গাঁধীজি অবধারিত ভাবেই গৌতম বুদ্ধর প্রসঙ্গ এনেছিলেন। অম্বেডকর এ বিষয়েও গাঁধীর সঙ্গে একমত হননি। তাঁর ব্যাখ্যা কিঞ্চিৎ সূক্ষ্মমার্গীয়, কিন্তু অবোধ্য নয়। অম্বেডকরের মতে, বুদ্ধর অহিংসা তত্ত্বর দুটো দিক আছে: একটাকে তিনি বলেছেন, ‘মূলনীতি’ (প্রিন্সিপ্ল), অন্যটাকে ‘নিয়ম’ (রুল)। মূলনীতির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি মাফিক কিছুটা স্বাধীনতার অবকাশ থাকে, তা একেবারে ধরা-বাঁধা নয়; কিন্তু নিয়ম জিনিসটা ধরা-বাঁধা, তাকে মানতেই হবে, না-মানলে আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন – যেমনটা হত হিটলারের জার্মানিতে। অম্বেডকরের মতে, বুদ্ধ অহিংসা-মূলনীতির কথাই বলছেন, অহিংসা-নিয়মের কথা বলেননি। আরও স্পষ্ট করে বললে, অহিংসা-নীতি বলতে কেবল ব্যক্তিগত স্তরের অহিংসা বোঝায় না, বোঝায় বৃহত্তর সামাজিক স্তরে অহিংসা। বর্ণাশ্রম কিংবা জাতিভেদ সেই বৃহত্তর অহিংসার নীতিকে লঙ্ঘন করে। বর্ণাশ্রম প্রথার গভীরে যে-হিংসা অন্তর্গ্রথিত সেটি বুদ্ধের অহিংসা-মূলনীতির বিরোধী। অহিংসার মূলনীতিতে অবিচল বুদ্ধ সেই সহিংস প্রথা মানেননি। অম্বেডকরের অভিযোগ, বৃহত্তর সামাজিক স্তরে বর্ণাশ্রম প্রথার, অর্থাৎ হিংসার, সমর্থন করে গাঁধী প্রকৃত অহিংসা-মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে অহিংসাকে কেবল একটি নিয়মে পরিণত করেছেন। অম্বেডকর এতদূর পর্যন্ত বলেন যে, বুদ্ধ-পরবর্তী যুগের যে সব ব্রাহ্মণ গৌতম বুদ্ধর অহিংসা-মূলনীতিকে ব্যক্তিগত স্তরে পালনীয় অহিংসা-নিয়মে পর্যবসিত করেছিল, গাঁধীজি তাঁদেরই অনুসারী, বুদ্ধর নন।
আর সেখানেও অনেক সমস্যা। পরিপূর্ণ যৌন সংযম আয়ত্ত হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করবার জন্য যে-তরুণীদের ব্যবহার করতেন সত্য-পরীক্ষক গাঁধীজি, এবং যে ভাবে করতেন, ধর্মের আচ্ছাদন থাকলেও সেটাকে হিংসা ছাড়া আর কী বলা যায়? তরুণীরা ভক্তিবশত তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করত বলেই হিংসার মাত্রাটা আরও প্রবল নয় কি?
অন্য আর এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাঁঠাবলি-বিরোধী এক জন কবি তাঁর নাটকের ভিলেনের মুখ দিয়ে হিংসার অনিবার্যতার সপক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। জয়সিংহর দ্বিধা-জর্জর মন থেকে হিংসার সর্বময় বৈধতা সম্বন্ধে যাবতীয় সংশয় দূর করবার জন্য একেবারে আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের কায়দায় কড়া অভিভাবন (সাজেস্শন) দিয়েছিল রঘুপতি: হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে,/হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে,/অগাধ সাগর-জলে, নির্মল আকাশে,/হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা খেলাচ্ছলে,/হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে,/চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে/ঊর্ধশ্বাসে প্রাণপণে— ব্যাঘ্রের আক্রমে/মৃগসম, মুহূর্ত দাঁড়াতে নাহি পারে।
অহিংসা একটি সর্বজনীন নৈতিক সত্য এবং সেটি হিন্দুধর্মের ওপর আধারিত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
বড় সাঙ্ঘাতিক এ-অভিভাবন। এর যুক্তি অকাট্য। এর মধ্যে ‘খেলাচ্ছলে’ আর ‘অকারণে’ শব্দগুলি বিশেষ করে ভাবায়। যে-লোক বাজারে মাছমাংস কাটে কিংবা ল্যাবরেটরিতে ব্যাং-খরগোশ-ইঁদুর-গিনিপিগ মারে, সে নিছক ‘জীবিকার তরে’ হিংসার আশ্রয় নেয়। অসুখ করলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে আমরা ব্যাক্টেরিয়া ‘মারি’, ফিনাইল দিয়ে জীবাণু ‘মারি’, এমনকি তেল ছিটিয়ে ডেঙ্গু-মশার লার্ভা ‘মারি’। এদের সকলেরই প্রাণ আছে। এগুলো ‘হত্যা অনিচ্ছার বশে’-র পর্যায়ভুক্ত। সেই কারণেই হয়তো গাঁধীজি ‘পাশ্চাত্য’ চিকিৎসা পদ্ধতির এত বিরোধী ছিলেন। কারণ সে-পদ্ধতির অন্যতম বনেদ হল রোগের পাস্তুর-প্রদর্শিত জীবাণু-তত্ত্ব। রোগমুক্ত হতে গেলে আপনাকে হিংসার আশ্রয় নিতেই হবে, জীবাণু মারতেই হবে, সে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়েই হোক, আর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেই হোক। তাই আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিরোধিতা গাঁধীজির অহিংসা-তত্ত্বর নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যেমন তাঁর মাংস না-খাওয়ার তত্ত্ব। ছোটবেলায় বন্ধুর পাল্লায় পড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মাংস খেতে শুরু করলেন কট্টর বৈষ্ণব ঘরের ছেলে মোহনদাস। মাংস খেলে গায়ে গত্তি লাগবে, ব্রিটিশ তাড়াতে সুবিধে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘ছাগলদের প্রতি আমার করুণা উবে গেল, মাংস না হোক, মাংসর পদগুলি আমি দিব্বি তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলাম। বছরখানেক এইভাবে চলল। তবে সব মিলিয়ে গোটা ছয়েকের বেশি মাংস-ভোজের আসর জমানো সম্ভব হয়নি।’ শেষ পর্যন্ত মাংস খাওয়া বন্ধ করলেন এবং বিবেকের পীড়া সামলালেন এই বলে যে, ‘বাবা-মাকে ঠকানোটা মাংস খাওয়ার চেয়েও খারাপ। তাই ওঁরা বেঁচে থাকতে মাংস খাওয়ার প্রশ্নটাই ওঠে না। যখন ওঁরা আর থাকবেন না, যখন আমি স্বাধীনতা ভোগ করব, তখন আমি প্রকাশ্যেই মাংস খেতে পারব, কিন্তু যতক্ষণ-না সেদিন আসছে, আমাকে এ থেকে বিরত থাকতেই হবে।’ কিন্তু পরে বিলেত যাওয়ার সময় মাকে কথা দিয়েছিলেন, মাংস খাবেন না এবং নারীসঙ্গ করবেন না। দুটি ‘পাপেরই’ শত প্রলোভন তিনি কী ভাবে জয় করেছেন, প্রায় ধর্মযুদ্ধর মতো করে তার সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন আত্মজীবনীতে। জীবনে আর কখনও মাংস খাননি গাঁধীজি।
কিন্তু প্রাণী হত্যার পাপ থেকে দূরে থাকবার জন্য যাঁরা মাছমাংস খান না, শাকাহার করেন, জগদীশচন্দ্র বসু পড়লে তাঁরা জানতে পারবেন, গাছ থেকে ঝিঙে কিংবা পটল ছিঁড়ে নেওয়ার সময় তাদের কত লাগে! এই উদ্ভিজ্জ পাপের ওজন বোধহয় কম। এটাকেও আমরা ‘অনিচ্ছার বশে’ হত্যা বলতে পারি।
কিন্তু ‘খেলাচ্ছলে’ হত্যা করে কারা? মানহাটান প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা যখন জাপানের আত্মসমর্পণ আসন্ন এবং অবধারিত জেনেও বোমাটি ফাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা কি ‘খেলাচ্ছলে’ই হত্যা করলেন না? অথচ আশ্চর্য এই, ওপেনহাইমার, যিনি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণকে গীতা-কথিত ‘সহস্র সূর্যের দীপ্তি’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, তিনি আবার আইনস্টাইনের শান্তিপ্রীতিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, সংস্কৃত ভাষায় প্রচলিত ‘অহিংসা’ শব্দটি দিয়েই এ-মনোভাবকে সবচেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কেননা এর অর্থ ‘কারও হানি না-করা’ ! সব থেকে অবাক-করা কথাটি হল ‘অকারণে’ হত্যা। অন্যান্য হিংসার কারণ আছে, সে সব কারণ সমর্থনযোগ্য হোক বা না-ই হোক। কিন্তু অকারণে হত্যা? অকারণ হিংসা? কোনও জন্তু এ কাজ করে না। কোনও কোনও মানুষ অবশ্য এ কাজ করে। তাদের আমরা কী বলব? ম্যানিয়াক? চেঙ্গিজ খাঁ কিংবা হিটলারের হত্যালীলাকে কী বলব? ‘লীলা’ কথাটার মধ্যে এই অকারণ পুলকে হত্যার ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে না?
কাজেই দাঁড়াল এই, অনেক মানুষকে উজ্জীবিত করার ব্যাপারে গাঁধীজির আইনস্টাইন-নন্দিত অহিংসা-তত্ত্বর যদি-বা কোনও ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকে; ঐতিহাসিক, দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিক বিচারে তার সার্থকতা কতটুকু তা রীতিমতো সন্দেহজনক।