দিলীপ ঘোষের সভায় আটকে পড়া অ্যাম্বুলেন্স।
বিশিষ্ট মার্কিন লেখিকা মারিয়ান উইলিয়ামসন এক সময়ে বলেছিলেন, 'Politics is in a crisis because it's separated from our deep humanity.'
সত্যিই রাজনীতি যেন ক্রমশ সঙ্কটে পরিণত হচ্ছে। এই তো সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা, মঞ্চে তখন নেতার বক্তৃতা চলছে। কর্মীরা সব মঞ্চের সামনে সার দিয়ে বসে। কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়েও আছেন। বক্তৃতা চলাকালীন একটা অ্যাম্বুল্যান্স আটকে পড়ল সেখানে। যে কোনও মিটিং-মিছিল, অবরোধ, এমনকি, বনধ্-হরতালেও সাধারণত কেউ অ্যাম্বুল্যান্স আটকান না— এটাই রীতি। সব কিছুর উপরে একটা প্রাণ। তাই এ ক্ষেত্রেও অ্যাম্বুল্যান্সের চালক এবং অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে থাকা রোগীর পরিজনেরা আন্দাজটুকুই করতে পারেননি, এ ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না। হুটার বাজানো অ্যাম্বুল্যান্স দেখেও কর্মীরা পথ ছাড়লেন না। উল্টে মঞ্চ থেকে নেতার হুঁশিয়ারি— এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ডিসটার্ব হয়ে যাবে। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যাক।
কিন্তু গাড়িটা যে অ্যাম্বুল্যান্স! হ্যাঁ, নেতা সেটাও দেখেছেন। কিন্তু নেতার আজব যুক্তি, তাঁর অনুষ্ঠান ভেস্তে দিতেই বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের চক্রান্ত এটি। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সে যে প্রসূতি রয়েছেন! সে ক্ষেত্রেও নেতার দাবি অ্যাম্বুল্যান্সে নাকি কেউ নেই! জলজ্যান্ত মানুষগুলো তা হলে কি ভূত? প্রসূতির মায়ের কাতর অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও ছাড় পেলেন না তিনি। অ্যাম্বুল্যান্স ছেড়ে দেওয়ার বদলে নেতার দাওয়াইয়ে উজ্জীবিত কর্মীরা অ্যাম্বুল্যান্সটিকে পিছন দিকে ঠেলতে লাগলেন। সবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হল অ্যাম্বুল্যান্স।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের ঘটনা। কৃষ্ণনগরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিজেপির সিএএ নিয়ে জণ জাগরণ যাত্রার মিটিংয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের অ্যাম্বুল্যান্স আটকানোর ঘটনায় সরব বঙ্গ রাজনীতি। সব মহল থেকে নিন্দিত ও ধ্বিকৃত হওয়ার পরেও নিজ মন্তব্যে অটল রয়েছেন তিনি। কৃষ্ণনগর প্রশাসনিক ভবন থেকে সদর হাসপাতাল যেতে সময় লাগে মোটামুটি এক মিনিটের মতো। ঘুরপথে যেতে গিয়ে সময় লেগে যায় প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো। হয়ে যেতে পারত কোনও ধরনের ক্ষতি, সে দিকেও খেয়াল নেই কারও। এমনকি, নেতারও না! এ ক্ষেত্রে একটা কথাই বলা যায়, তা হল— ঘটনাটি অমানবিক।
কৃষ্ণনগরের পর নদিয়ারই আরেক শহর রানাঘাট। রানাঘাট কলেজের সামনে, মানবতার মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির পিছনে একই কর্মসূচি উপলক্ষে বিজেপিরই মিটিং। একই নেতার এ বারের হুঁশিয়ারি— ক্ষমতায় এলে অনুপ্রবেশকারী এবং এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের গুলি করে মারবেন, যেমনটা নাকি তাঁর দলের সরকার অসম, উত্তরপ্রদেশ নাকি কর্ণাটকে করেছে! তাঁর আরও দাবি, এরা ভোটার বলে নাকি রাজ্যের সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
দিলীপ ঘোষ এই সব বলার পরেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে নিজের দলের জন্য ভোট চাইছেন। আবার, দাবিও করছেন দু’হাজার একুশের ভোটে তাঁরাই জিতবেন!
অমানবিকতার নজির গড়ে ভোট চাইতে লজ্জা করে না— প্রশ্ন নেটিজেনদের? তাঁর এই ‘‘গুলি করে মারব’’ মন্তব্যে অনেকেই ভীত-সন্ত্রস্ত। কতটা অমানবিক হলে অ্যাম্বুল্যান্স আটকানো যায় নিজের দলের রাজনৈতিক স্বার্থচরিতার্থ করার জন্য, তা ভাবতেও লজ্জা হয়। কিন্তু এতটা অমানবিক হলে মানুষ রাজনীতিকে স্বাগত জানাবেন কেন? মনে রাখা দরকার, মানবতা রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গাঁধীজি, নেতাজিরা স্বয়ং ছিলেন মানবতাবাদের পূজারী। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে রাজনীতিতে ক্রমশ অমানবিকতার বিস্তার ঘটছে। সাম্প্রতিক প্রায় সব ক’টি নির্বাচনই রক্তাক্ত হয়েছে। প্রতিবাদ করায় এবং বিরুদ্ধমত পোষণ করায় শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত রক্তাক্ত হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে গার্লস হস্টেলে ঢুকে ছাত্রীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার ঘটনায় কিংবা একটা গণধর্ষণের ঘটনার পর নেতানেত্রীরা যখন সেখানে সাজানো ঘটনার তত্ত্ব খাড়া করে, অবশ্যই রাজনীতির কবলে পদদলিত হয় মানবতা। অথচ, যাঁদের অ্যাম্বুল্যান্স আটকানো হয় অথবা যাঁদের প্রকাশ্যে গুলি করে মারার হুমকি দেওয়া হয়, তাঁদের ভোটে নির্বাচিত এক জন জনপ্রতিনিধি কী করে ভোটারের প্রতিই এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন? এতটা অমানবিক রাজনীতিকে স্বাগত জানাতে জণগণ কীসের জন্য ভোট দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন? এটা এই সব রাজনীতিকেরা এক বারও ভাবছেন না।
আবার, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কিংবা নোটবন্দি প্রভৃতি বিষয়ে নথিপত্র দেখানোর নাম করে কিংবা নোট বদলের নাম করে আমজনতাকে একপ্রকার হেনস্থা করাটাও আরেক ধরনের অমানবিকতার নজির।
এমনতিই রাজনীতি সম্পর্কে নেটিজেনদের বিশেষ আগ্রহ নেই। যদিও কোনও বড় ঘটনা ঘটলে সবার আগে একজোট হয়ে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যান তাঁরাই। সেই নেটিজেনদেরই দাবি, এ বার অন্তত সুস্থ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে রাজনীতিতেও ফিরে আসুক মানবতা। নতুবা মানুষও কিন্তু বিকল্প খুঁজবে।
রানাঘাট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র