পরিবার-নির্ভরতা কমানোর কাজ করতে হবে রাহুল গাঁধীকেই
Congress

রাস্তায় নামাই একমাত্র রাস্তা

সনিয়া গাঁধীর সেই ‘বকুনি’-র পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব, মোদী সরকারের আমলে আমজনতার রুটিরুজির সমস্যা, চাকরির অভাবের দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করেছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

সনিয়া গাঁধী কি সে-দিন নিজের ছেলেকেই বার্তা দিয়েছিলেন! মাস পাঁচেক আগের সেই দিনটাও বৃহস্পতিবারই ছিল। চব্বিশ নম্বর আকবর রোডে এআইসিসি-র সদর দফতরে দিনভর প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল।

Advertisement

গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর। নতুন করে অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর, সে দিনই প্রথম বার সনিয়া সব রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। নির্দেশ দেন, রাস্তায় নামুন। মানুষের পাশে দাঁড়ান। আর্থিক হোক, সামাজিক হোক, মানুষের সমস্যা নিয়ে গ্রামে-শহরে রাস্তায় নেমে লড়াই করুন। শুধু ঘরে বসে টুইট করবেন না।

শেষের এই বাক্যটিই জল্পনা উস্কে দিয়েছিল। এটা কি রাহুল গাঁধীর প্রতি বার্তা? বাজপেয়ী সরকারের আমলে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর প্রচারের বিরুদ্ধে গোটা দলকে রাস্তায় নামিয়েই ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বাজিমাত করেছিল। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা সে-দিন ভেবেছিলেন, পুরনো ফর্মের সনিয়ার প্রত্যাবর্তন ঘটল।

Advertisement

তার পরে পাঁচ মাস কেটে গিয়েছে। সনিয়া গাঁধীর সেই ‘বকুনি’-র পরে কংগ্রেস নেতৃত্ব, মোদী সরকারের আমলে আমজনতার রুটিরুজির সমস্যা, চাকরির অভাবের দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। যে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের ধার ও ভার ধরে রাখতে গেলে সংগঠনের জোর দরকার। কংগ্রেসে এখন সংগঠন নামক বস্তুটি লুপ্তপ্রায়। মহিলা কংগ্রেস, যুব কংগ্রেস বা সেবা দলের মতো দলীয় সংগঠন মাঝে মাঝে হাউইয়ের মতো ভেসে ওঠে। আবার হারিয়ে যায়।

গত পাঁচ মাসে রাহুল গাঁধী যত না রাস্তায় নামার জন্য খবরে এসেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি খবরে এসেছেন তাঁর ‘অঘোষিত’ বিদেশ সফরের জন্য। কবে, কখন, কোন দেশে তিনি চলে যান, তার কিছুই জানানো হয় না। দলের নেতাদের কাছে সমস্যা হল, রাহুল গাঁধী গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উধাও হয়ে যান। আবার হঠাৎ উদয় হয়ে টুইট করে মোদী সরকারকে আক্রমণ করেন। আবার অদৃশ্য হয়ে যান।

সনিয়া গাঁধী অসুস্থ। ডিসেম্বরেই ৭৩-এ পা দিয়েছেন। বেশি দিন তিনি আর অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর পদে থাকতে চাইছেন না। ফের রাহুল গাঁধীকে কংগ্রেস সভাপতি পদে ফেরানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। রাহুল এখনও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। বলা বহুল্য, দায়িত্ব নিলে তিনি নিজের মতো দল চালানোর স্বাধীনতা চাইবেন। নিজের পছন্দের তরুণ নেতাদের নেতৃত্বে তুলে আনতে চাইবেন। কিন্তু সনিয়ার শিবিরের নেতাদের প্রশ্ন, এই সব তরুণ নেতার তো দলকে ভোটে জেতানোর দক্ষতা নেই। তাঁরা নিজের এলাকা থেকেই জিতে আসতে পারেন না। অধীররঞ্জন চৌধুরী হাজার ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও নিজের বহরমপুরের আসন ঠিক ধরে রাখেন। কিন্তু জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ারা নিজেদের গড় থেকেই লোকসভায় জিতে আসতে পারেন না। বিধানসভা ভোটের বৈতরণি পার হওয়ার জন্য সেই কমল নাথ, অশোক গহলৌত, ভূপিন্দর সিংহ হুডার মতো প্রবীণ নেতাদের উপর ভরসা করতে হয়। এই প্রবীণ নেতাদের ইচ্ছে, রাহুল সভাপতি হলে হোন। কিন্তু দলের মধ্যে বিশেষ রদবদল করা চলবে না। অর্থাৎ, তাঁদের হাত থেকে দায়িত্ব বা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া চলবে না।

কংগ্রেসে এখন কার্যত ‘মুষল পর্ব’ শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ না-হয় কাল কংগ্রেসের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতই। দিল্লির ভোটে কংগ্রেসের বিপর্যয় আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোট, ২০১৫ ও ২০২০-র বিধানসভা ভোট— টানা চার বার দিল্লি থেকে খালি হাতে ফেরার রেকর্ড করে ফেলেছে কংগ্রেস। তা সত্ত্বেও বিজেপির হার, আম আদমি পার্টির জয়ে খুশি হতে দেখে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় পি চিদম্বরমকে আক্রমণ করছেন। আম আদমি পার্টির সাফল্যে মজে যেতে দেখে মিলিন্দ দেওরাকে দল ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অজয় মাকেন।

আসল প্রশ্ন হল, এই সমুদ্র মন্থনে কি শুধুই হলাহল উঠবে? না কি, শেষ বেলায় কংগ্রেসকে জিইয়ে রাখার অমৃত উঠে আসবে?

গাঁধী পরিবারকে আঁকড়ে ধরেই ফের কংগ্রেস নেতারা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। গত কয়েক দশক ধরে গাঁধী পরিবারই কংগ্রেসের নিউক্লিয়াস এবং তুরুপের তাসও। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ফুটিফাটা কংগ্রেস পরিবারকে আঠার মতো আটকে রাখার কাজটি করে চলেছে এই গাঁধী পরিবারই। উল্টো দিকে, এই

গাঁধী পরিবারের জন্যই কংগ্রেসে ‘হাইকমান্ড সংস্কৃতি’ শিকড় বসিয়েছে। সংগঠন মজবুত করার কাজ শিকেয় উঠেছে। তার ফলও গাঁধী পরিবারই ভুগেছে। নিচুতলায় সংগঠনে ঘুণ ধরে যাওয়াতেই গাঁধী পরিবারের গড় অমেঠীতেই রাহুল গাঁধীকে হারতে হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা হল, আমজনতার মধ্যে, কিছুটা পার্টির মধ্যেও, গাঁধী পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা কমে এসেছে। সেই ম্যাজিক আর কাজ করছে না। রাহুল গাঁধীর অনেক রণকৌশলের সঙ্গে পার্টির নেতারা একমত হতে পারছেন না। প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা দিল্লিতে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের আন্দোলনে যোগ দিতে ছুটছেন। কিন্তু গোটা দল তাঁর সঙ্গে আসছে না। মুশকিল হল, তা সত্ত্বেও কংগ্রেসের নেতারা গাঁধী পরিবার ছাড়া আর কোনও বিশল্যকরণী খুঁজে পাচ্ছেন না।

সনিয়া নিজেই বিশল্যকরণী দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রাস্তায় নামার, আমজনতার সমস্যা নিয়ে লড়াই করার দাওয়াই দিয়েছিলেন তিনি। বস্তুত এই দাওয়াইতেই গুজরাত বিধানসভা ভোট থেকে ছত্তীসগঢ়-মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থানের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ভাল ফল করেছিল। গুজরাতে শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে হটাতে না পারলেও, কংগ্রেস গুজরাতের গ্রাম ও আদিবাসী এলাকায় বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধস নামিয়েছিল। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যেও কংগ্রেসের বাজিমাতের কারণ ছিল, দলিত, আদিবাসী, বিশেষত গরিবদের ভোট ঝোলায় পোরা। ছত্তীসগঢ়-মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান, তিন রাজ্যেই কংগ্রেস বিজেপির তুলনায় গরিব আমজনতার ভোট অনেক বেশি পেয়েছে বলেই ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। কংগ্রেস এই সব রাজ্যে আমজনতার সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছিল। দলিত-আদিবাসী-গরিব মানুষকে ছুঁতে পেরেছিল। তারই ফল মিলেছে।

এমন নয় যে রাহুল গাঁধী মানুষের সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামার, বা নিচুতলার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির প্রয়োজন বোঝেন না। অরবিন্দ কেজরীবাল যখন ২০১৩-য় কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রথম বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হলেন, সে বারই রাহুল গাঁধী আবিষ্কার করেছিলেন, আম আদমি পার্টি সমাজের এমন সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে ফেলেছে, অন্য কোনও রাজনৈতিক দল যাদের খবরই রাখে না। রাহুল বলেছিলেন, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আরও বেশি করে, আরও বেশি সংখ্যক নিচুতলার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলব।

তার পরে সাত বছর কেটে গিয়েছে। কেজরীবাল একই ফর্মুলা মেনে তৃতীয় বার দিল্লির ক্ষমতায় এসেছেন। কংগ্রেস এখনও যে-তিমিরে, সেই তিমিরেই। কারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির জন্য কংগ্রেসের সেবা দলের মতো যে ক্যাডার বাহিনী প্রয়োজন ছিল, কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে সনিয়া গাঁধীর ১৯ বছরের ইনিংসে ‘হাইকমান্ড সংস্কৃতি’-র জোয়ারে অধিকাংশ রাজ্যেই তা সাফ হয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই সনিয়া হাজার

চেষ্টা করেও তামিলনাড়ু বা ওড়িশায় দলের হাল ফেরাতে পারেননি। যেখানে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেখানেই কংগ্রেসকে লেজুড়বৃত্তি করতে হয়েছে।

কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুল গাঁধী যদি আবার ফিরে আসেন, তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে গাঁধী পরিবারের উপর কংগ্রেসের নির্ভরতা কমিয়ে ফেলা। গাঁধী পরিবারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকার সংস্কৃতিকে বিদায় জানানো। রাজনৈতিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে, দরকার পড়লেই মানুষের সমস্যা নিয়ে রাস্তায় নামার অভ্যাস তৈরি করা। এর মধ্যে থেকেই তাঁকে নতুন নেতৃত্ব তুলে আনতে হবে। কখনও তাতে ভাল ফল মিলবে, কখনও খারাপ। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে যে শূন্য হাতেই ফিরতে হবে, দিল্লির বিধানসভা ভোটের ফলই তার প্রমাণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement