তবে ইহাই সাব্যস্ত হইল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চল্লিশ বৎসর যাবৎ প্রচলিত ভর্তি প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন হইল। সিদ্ধান্তটি শুনিয়া প্রথমেই জিজ্ঞাসিতে ইচ্ছা করে: কেন? যুক্তিটি ঠিক কী? স্নাতক স্তরের ভর্তি লইয়া কি বড় মাপের অভিযোগ ছিল? প্রক্রিয়াটি কি কোনও ভাবে সমস্যা তৈরি করিতেছিল? শিক্ষক-পরীক্ষকরা কি দুর্নীতিতে গ্রস্ত হইয়াছিলেন? ছাত্রছাত্রী নির্বাচনের মানদণ্ডে কিংবা বিভাগীয় পড়াশোনার মানরক্ষায় কি সঙ্কট তৈরি হইতেছিল? না, পরিবর্তনের মহা-কান্ডারিরাও দাবি করিতে পারিবেন না যে প্রশ্নগুলির একটিও প্রাসঙ্গিক। ঘটনা হইল, এতগুলি দশক ধরিয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবেই চলিয়া আসিয়াছে। পড়াশোনার মান লইয়া অভিযোগের জায়গাও স্বল্প, রাজ্যের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয় ইহাই। যে বিভাগগুলিতে ভর্তি-পরীক্ষা চালু ছিল, প্রতিটিই নামী বিভাগ, বিশেষ করিয়া গোটা তিনেক বিভাগ তো দেশের মধ্যেই শীর্ষস্থানীয়। দূর কিংবা নিকট অতীতে যথেষ্ট সুশৃঙ্খল ভাবেই ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হইতে দেখা গিয়াছে। অর্থাৎ, কোনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কারণ ছাড়াই পরিবর্তনটি ঘটানো হইল। সন্দেহ হয়, রাজ্য সরকারের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এত অসামান্য সুষ্ঠু শাসনের দৃষ্টান্ত হইয়া উঠিয়াছে বলিয়াই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রকের কাছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কার’ই এখন সব চেয়ে জরুরি!
কোনও কাজের পিছনে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কারণ না মিলিলে মানস-জাগতিক হেতুই খুঁজিতে হয়। সেই সন্ধান বলিতেছে, গত কয়েক বৎসরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ তৃণমূল কংগ্রেস দলটিকে বড় বড় মানসিক ধাক্কা দিয়াছে। অনেক প্রচেষ্টাতেও শাসক দল তাঁহাদের কব্জা করিতে পারে নাই। ভর্তি-পরীক্ষা লইয়া এ হেন ব্যস্ততার কারণটি এখানেই নিহিত। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কোমর বাঁধিয়া নামিয়াছেন দলীয় দাপটের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতি স্বীকার করানোর জন্য। সর্বসমক্ষে বলিয়াছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ছাত্র-ভর্তি তাঁহার ‘পছন্দ’ নয়। শিক্ষামন্ত্রী তো মন্ত্রী মাত্র, শিক্ষাবিদ নন, তাই তাঁহার পছন্দ অপছন্দে কী-ই বা আসে যায়, এই সব প্রশ্ন উঠিতে পারে আন্দাজ করিয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মহাশয় দ্রুত সামাল দিতে চাহিলেন, বলিলেন: না, না, এ সবের সহিত মন্ত্রীর মতামতের কোনও সম্পর্ক নাই, মতের মিলটি ‘কাকতালীয়’। অভিজ্ঞ পশ্চিমবঙ্গবাসী অবশ্য জানেন যে কাক ও তালের সম্পর্কটি এ রাজ্যে সংযোগবিহীন নহে। বার বার ঠুকরাইয়া কাকমশাই গাছের তাল দিব্য ফেলিয়া দিতে পারেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় পছন্দ করিতেছেন না, ইহার পরও কি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-পরীক্ষা থাকা সম্ভব?
কুলোকে বলিতেছে, যাদবপুরের ‘মমতায়ন’-এর মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেস অবশেষে পূর্বসূরি বাম ফ্রন্টের উপযুক্ত উত্তরসূরি হইতে পারিল। এ বার যাদবপুরে কর্মসমিতি বৈঠকে ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত যে ভাবে গৃহীত হইয়াছে, তাহাই শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্র প্রকাশ ও বিকাশের যথার্থ সিলমোহর। সমগ্র পৃথিবীতে উৎকর্ষ-কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় কোন পদ্ধতিতে ছাত্র লইবে, কী ভাবে পড়াইবে ইত্যাদি বিষয় নিজেই স্থির করে। এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় কিন্তু ‘উৎকর্ষ’ কোনও নিকট বা দূর লক্ষ্য নয়, বাম আমল হইতে শুরু করিয়া আজ পর্যন্ত সরকারি প্রতাপের তলায় তাহাকে আনাই প্রধান লক্ষ্য। যাদবপুরে বিভিন্ন বিভাগের মানী, কৃতী, সফল অধ্যাপকদের মত পদদলিত করিয়া মন্ত্রীর মতকে স্থাপন করিবার এবং মেরুদণ্ড বিসর্জন দিয়া উপাচার্য মহাশয়ের শাসক দলের ছড়িটি নিজ স্কন্ধে বহন করিবার ঘটনায় প্রমাণ, সর্বনাশের বৃত্ত এ বার সম্পূর্ণ। একা বাম যাহা করিতে পারে নাই, তৃণমূল দোসরের সৌজন্যে এ বার তাহা সম্পন্ন হইতে বসিয়াছে।