প্রতীকী ছবি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন জীবনে দাগ রেখে যেতে। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে সম্পূর্ণ অন্য অর্থে যেন অন্য দাগ রেখে যাওয়ার চেষ্টা চলছে! দাগ রাখা হচ্ছে অকথা-কুকথা, মিথ্যাভাষণ আর অপরাধের পথে।
সংগঠিত বা একক অপরাধের ক্ষেত্রে আশা করা যায় যে, অপরাধী ধরা পড়বে, তার যথাযোগ্য বিচার এবং শাস্তিবিধান হবে। এই দেশে অনেকসময় বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদলেও এখনও বিচারব্যবস্থার উপর দেশের মানুষ আস্থা হারায়নি। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ক্ষোভ-রাগ-অভিমান-হতাশা থাকলেও শেষপর্যন্ত নাগরিক বিচারব্যবস্থার উপরই ভরসা রাখেন।
কিন্তু শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে অকথা-কুকথার যে ধারাবাহিকতা চলছে, তার বিচার কে করবে? যারা এই ধারাবাহিকতা বয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁদের ধরবেই-বা কে? বিস্মিত হতে হয় দেখে যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বসে দিনের পর দিন দেশ ও দশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক কাজটি কিন্তু অনেকে সুচারু ভাবে করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা শুধু শুনে যাচ্ছি, কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছি না। কেননা, ইচ্ছাকৃত ভাবে যাঁরা এগুলি করছেন, তাঁদের পিছনে কখনও রয়েছে বৃহত্তর সংখ্যার কিছু মানুষের প্রশ্রয় আবার কখনও রাষ্ট্রীয় মদত। সুতরাং যথেষ্ট শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই ব্যক্তিরা অসংযমী কথাবার্তা বলে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করছেন, যার ফল অচিরেই মারাত্মক হতে চলেছে।
ভাবতে অবাক লাগে যে, আধুনিক এই সময়ে দাঁড়িয়েও যাঁরা জাতি ও বর্ণভেদ প্রথাকে সমর্থন করে গরম গরম কথা বলে চলেছেন, তাঁরা কি একটিবারও ভাবছেন না যে, এর ফলে দেশের সুস্থিতি ও সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে? এতটাই বোকা তাঁরা? না, তাঁদের এতটা বুদ্ধিহীন ভাবাটা ভুল হবে। আর সে জন্যই আশঙ্কা জাগছে যে, আসল উদ্দেশ্যটা ঠিক কী!
নিত্যদিন দেশের আর্থিক বৃদ্ধি কমছে। বাড়ছে বেকারত্ব। ছাঁটাই হচ্ছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ চলছে। বিভিন্ন খাতে কমছে ভরতুকি। ধর্মের ভিত্তিতে চলছে নাগরিকদের চিহ্নিত করার কাজ। কোনও সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহী তকমা। অমর্ত্য সেন, রামচন্দ্র গুহর মতো ব্যক্তিত্বকে সইতে হচ্ছে অপমান। বিরুদ্ধ-ভাবনার ছাত্র-ছাত্রীদের 'পথে' আনতে রাতের অন্ধকারে মারধর করতে মুখ ঢেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুষ্কৃতীর দল প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্রে অতিসক্রিয় রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রয়োজনের সময়, ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকছে। কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে দেখানো হচ্ছে রাষ্ট্র থেকে বিতারণের ভয়। কোনও কোনও রাজ্যকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রদোহীদের আশ্রয় বলে। ইচ্ছে করলেই যে কোনও ব্যক্তিকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে জেলবন্দি করে রাখার মোক্ষম অস্ত্রটিও প্রয়োগ করছে কোনও কোনও রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসন। আর এসব করতে গেলে যে মিথ্যাচার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতের পুতুল তৈরি করা দরকার, তাও করা হচ্ছে সুচতুর ভাবে। সাহায্য নেওয়া হচ্ছে সর্বস্তরের, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ারও। সাংবিধানিক প্রধানেরাও তাঁদের পদমর্যাদা ভুলে নেমে পড়েছেন এই সার্কাসে। আর এই করুণ চিত্রে সাধারণ ভারতবাসী দাঁড়িয়ে আছেন খাদের একদম কিনারে।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে স্তম্ভিত করে দেওয়া কিছু অদ্ভুত তত্ত্ব। সেসব শুনে সবারই 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' দশা। এইসব চমকপ্রদ তত্বের উপস্থাপনা এখন এতটাই প্রচলিত যে, আজকাল আর কেউ বিস্মিত হয় না। বরং 'এরকমটাই হওয়ার ছিল' ধারণাটি যেন দিনদিন গেঁথে যাচ্ছে আমজনতার মনে। কেননা তারা বুঝে গিয়েছে যে, তাদের দুরবস্থা কোনওভাবেই পাল্টাবে না। বছর বছর ভোট আসবে, তারা ভোটটিও দেবে এবং এইসব কাণ্ডকারখানাও সহ্য করবে শুধু এইটুকু আশায় যে, অবস্থার যদি সামান্য হলেও উন্নতি হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনাটুকুও দেখা যাচ্ছে না। উল্টে দিন দিন আরও অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছি আমরা। এর শেষ যে কোথায়,ঈশ্বরও জানেন না।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয় যে, বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে সমর্থন করে চলেছেন। যুক্তি হিসেবে তারা অনেকসময়ই অতীত টেনে আনছেন। কিন্তু তাঁদের সেই সময় যখন এরকম হয়েছিল তখন কী করছিলেন জাতীয় হাইপোথেটিক্যাল ও হাস্যকর কথাগুলি ধোপে টেকে না, কেননা সেই সময়কে বদলাতেই পরিবর্তনটি করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে, সেই সময়ের চাইতে উন্নততর ও আধুনিকতর কাজকর্ম ও চিন্তার পেছনে থাকবে রাষ্ট্র। কিন্তু তা না করে যদি অতীতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্তমানটি ঘুরপাক খায়, তবে আর যাই হোক দেশের প্রগতি আসবে না। এমনিতেই আর কয়েক বছর পর পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ হতে চলা ভারতের সমস্যার শেষ নেই, তার উপর যদি এসব কিছুতেই রাষ্ট্র মত্ত থাকে, তবে কবে আর সত্যি বদল আসবে! নাকি ‘বদল’ শব্দটি সোনার পাথরবাটিই হয়ে রইবে! দেশের বিপুল জনসংখ্যা যেমন মাথাব্যথার কারণ, তেমনি তা কিন্তু অন্য অর্থে মানবসম্পদও। একথা ভুললে চলবে না যে, এই বিপুল মানবসম্পদকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে তা বদলে দিতে পারে দেশকে। কিন্তু তা না করে যে ছায়াযুদ্ধে আজ রাষ্ট্র নিজে মেতে উঠেছে এবং অন্যদের মাতিয়ে তুলছে, তার ফল কি হতে পারে ভেবে শিউরে উঠতে হয়।
আসলে নির্মাণের কোনও শব্দ হয় না। কিন্তু পতনের শব্দটি বিকট। সংবিধানে বর্ণিত যে আদর্শ, ভাবনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের নির্মাণ হওয়া উচিত, তা পতনের ভারী শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। আর সেই পতন যারা আনছে, সময় তার নিজের ধূসর পাতায় কোনওদিন তাদের ঠাঁই দেবে না। যুগে যুগে মানবেতিহাস সেই কথাই বলে।
(লেখক কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)