দক্ষিণ কোরিয়ায় চলিতেছে ‘কফিন থেরাপি’। ইহার সারার্থ হইল, মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর অভিজ্ঞতা গ্রহণ। মানুষ এই থেরাপি-কেন্দ্রে যাইতেছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দেওয়া হইতেছে ও তাহার পরে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হইতেছে। তাহাতে হয়তো দেখানো হইল এক ক্যানসার রোগীর আখ্যান, যিনি জীবন আর মাত্রই কয়েকটি দিন জানিয়াও, অবশিষ্ট দিনগুলির পূর্ণ ব্যবহার ও আস্বাদন করিয়া লইলেন। অথবা হয়তো দেখানো হইল এমন এক প্রতিবন্ধীকে, যাঁহার হস্ত-পদ নাই, অথচ তিনি যাপনকে অর্থময় করিয়া লইয়াছেন। ইহার পরে অন্ত্যেষ্টির উপযুক্ত পোশাক পরিয়া, নিজের শেষ ইচ্ছাপত্র লিখিতে হয়। তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা নহে, স্নেহের বা প্রেমের মানুষদিগের প্রতি নিজের শেষ কথাগুলি লিপিবদ্ধ করিবার প্রয়াস। তাহার পর কফিনে শয়ন। এক কৃষ্ণপোশাক পরিহিত ব্যক্তি আসিয়া কফিনের ডালাগুলি হাতুড়ি মারিয়া আঁটিয়া দিয়া যায়। দশ মিনিট সেই ঘনান্ধকার কফিনে শুইয়া থাকিতে হয়। কেহ কাঁদিয়া ফেলেন, কেহ চুপ করিয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া থাকেন, প্রায় সকলেই বলেন, এই সময়টির ভাবনা তাঁহাদের জীবনকে নূতন ভাবে দেখিতে শিখাইল। কেহ পূর্বে আত্মহত্যার কথা ভাবিতেছিলেন কিন্তু এই কফিন-যাপনের পর জীবনের দিকে হেলিয়াছেন। কেহ অনারোগ্য অসুখে ভুগিতেছেন ও ইহার পর মৃত্যুভয় কিয়দংশ কাটাইয়া উঠিয়াছেন। কেহ বলিয়াছেন, তিনি শত্রুদের ক্ষমা করিতে ও বন্ধুদের অধিক ভালবাসিতে শিখিয়াছেন। অনেকেরই মনে হইয়াছে, জীবনে কত অবান্তর ব্যাপার লইয়া ব্যাপৃত পীড়িত চিন্তিত আছেন, অগ্রাধিকারের তালিকা গুছাইয়া লইতে হইবে। অফিস হইতে কর্মীদের এই থেরাপি করানো হইতেছে, ইহা নাকি আশ্চর্য জীবন-উদ্দীপক হিসাবে কাজ করিতেছে। আয়োজক বলিয়াছেন, মানুষ নিজের পুরাতন সত্তাকে কফিনে রাখিয়া বাহির হইয়া আসিতেছেন। সত্যই ইহাকে পুনর্জন্ম আখ্যা দেওয়া হয়তো অতিরিক্ত কাণ্ড হইয়া যাইবে, কিন্তু বর্তমান নাগরিক সমাজে, মৃত্যুকে জীবনের চালিকাশক্তির উপাদান হিসাবে ব্যবহার অভিনবত্বের দাবি রাখে।
যুধিষ্ঠির বককে বলিয়াছিলেন, এত লোক প্রতি দিন মরিতেছে, তথাপি প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বাস করিতেছে যে তাহার মরণ হইবে না, ইহা অপেক্ষা বড় বিস্ময় আর নাই। কিন্তু কেহ এই বিস্ময়কর বিস্মরণকেই মানুষের সর্বোচ্চ প্রতিভা বলিয়াও চিহ্নিত করিতে পারেন। মৃত্যু হইবে জানিয়া, ‘তবে তো সকলই বৃথা, শয্যা ছাড়িয়া উঠিব কোন যুক্তিতে’ না বলিয়া, মানুষের এই যে সানন্দ রাজ্যবিস্তার, ক্ষুদ্র মুহূর্তগুলিকে চাটিয়াপুটিয়া লওয়া, এমনকি আদর্শ রক্ষার জন্য মৃত্যুকে তাহার নির্ধারিত লগ্নের বহু পূর্বেই বরণ করিয়া লওয়া, এইগুলিই মানুষকে জয়ী করিয়াছে। মানুষ এমন অদ্ভুত কথাও ভাবিয়া পাইয়াছে, তাহার দেহের (ও মনের) মৃত্যু হইলেও, তাহার কীর্তি যদি অন্য মানুষের স্মৃতিতে বহু দিন জাগ্রত থাকে, তবে সে মৃত্যুকে এক প্রকারে পরাজিত করিল। মৃত্যু হয়তো এই কথা শুনিয়া হাসিয়া বাঁচে না যে কাহারও রচনাবলির পঞ্চবিংশতি সংস্করণ মুদ্রিত হওয়ার মধ্যে যমের পরাভব রহিয়াছে, কিন্তু মানুষ যে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাহাতে বুঝা যায়, সে তাহার অনিত্য অস্তিত্বটি অতিক্রম করিয়াও ভাবিতে জানে। এবং জানে অবসানকে প্রণোদক হিসাবে ব্যবহার করিতে। বোর্হেস লিখিয়াছিলেন, মানুষ ব্যতীত সকল প্রাণীই অমর, কারণ তাহারা জানে না যে মৃত্যু আছে। নিঃসন্দেহে ইহার অনুসিদ্ধান্তও সত্য: মানুষই প্রকৃত অমরত্ব-অভিলাষী, কারণ সে সচেতন ভাবে এই মরত্ব পার হইয়া মহাকালকে জয় করিতে চাহে।
কফিনে শুইয়া এই মর্মে গুরুগম্ভীর নিবন্ধ হয়তো দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষেরা রচনা করিতেছেন না, কিন্তু ইহাতে সন্দেহ নাই, ‘যেন-মৃত্যু’র এই ক্ষণিক ও মিথ্যা অভিজ্ঞতা তাঁহাদের কিছু মৌলিক প্রশ্নের দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। তাঁহারা অন্তত এই কথা ভাবিতেছেন, এত দিন যে-চাকুরিটি যাইবার ভয়ে তটস্থ ছিলেন, তাহা সত্যই সীমিত জীবনের পক্ষে অর্থপূর্ণ কি না। নিজের প্রতি নিবিড় মনোযোগের এই অবকাশ ও ক্ষেত্রটিও তো সেলফোন-পীড়িত মানবজাতি অন্যত্র পায় না। আত্মীয়ের দাহকার্যে শ্মশানে যাইয়া অনেকের মনে অনিত্যতা-জনিত দার্শনিক প্রশ্নের উদয় হয়, কিন্তু বাহিরের বহমান রাজপথ তাহাকে সেই চিন্তা হইতে ঘাড় ঘুরাইবার প্রশ্রয় দেয়। যুধিষ্ঠির হয়তো বলিবেন, এখনও ইলেকট্রিক-চুল্লি-থেরাপি শুরু হইল না, ইহা যথেষ্ট বিস্ময়ের!