দীর্ঘক্ষণ নিশ্চল থাকিবার পর সহসা উঠিলে পায়ে ফের রক্তসঞ্চালন শুরু হয়, তাহাতে এক প্রকার ঝিনঝিনে ব্যথার অনুভূতি হইয়া থাকে। দেড় মাস লকডাউনের পরে সমাজ যখন তাহার স্বাভাবিক গতিতে ফিরিবে, তখনও এমন এক সাময়িক বেদনার অনুভব হইবে। সেই বেদনা আত্মনিবারণের। নিয়মিত সংযম পালনে কয় জনই বা অভ্যাস করিয়াছেন, তাই মুক্তি পাইবার পরেও নিষেধ মানিয়া চলিতে হইলে তাহা অন্যায় দাবি বলিয়া মনে হইতে পারে। কিন্তু নিরন্তর সতর্কতাই করোনা-উত্তর ‘নূতন জীবন’। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, পরিস্থিতি কবে করোনা-পূর্ব সময়ের ন্যায় হইবে, আদৌ কখনও হইবে কি না, তাহা অনিশ্চিত। এখন মারি লইয়া ঘর করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। লকডাউন শিথিল হইবার বিস্তারিত নির্দেশ বাহির করিবে কেন্দ্র ও রাজ্য। এ রাজ্যেও লকডাউন না উঠিলেও শর্তসাপেক্ষে নানা কাজের ছাড়পত্র মিলিবে। কিন্তু তাহার অর্থ পূর্বের অভ্যস্ত জীবনে ফিরিবার ছাড়পত্র নহে, তাহা বুঝাইতেই বিভিন্ন রঙের এলাকায় ভাগ করা হইয়াছে মহানগর ও জেলাগুলিকে। ইহা তাৎপর্যপূর্ণ যে লাল, অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বিপদগ্রস্ত অঞ্চলগুলির মধ্যেও তিনটি বিভাগ আনিতেছে রাজ্য। তীব্রতা অনুসারে সেগুলিতে কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হইবে। মানুষের প্রয়োজন বুঝিয়া, বিশেষত জীবিকাসংস্থানের জন্য রাজ্য সরকার নমনীয় হইতে সম্মত, লালের মধ্যেও স্তর-বিন্যাস তাহার ইঙ্গিত।
বহু মানুষের নিকট কাজে বাহির হইবার অনুমতি বাঁচিবার ছাড়পত্র হইয়া আসিবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহা মারণরোগকে ছড়াইবার সুযোগ করিয়া দিবে কি না, সে সংশয় থাকিতেছে বলিয়াই কোন অঞ্চলে কী শর্তে পরিবহণ চালু হইতে পারে, কোন ধরনের দোকান খুলিতে পারে, তাহার বিস্তারিত রূপরেখা তৈরি করিতেছে সরকার। যাঁহারা সকল নিয়ম নস্যাৎ করিতে অভ্যস্ত তাঁহাদের নিকট এই খুঁটিনাটি অর্থহীন মনে হইতে পারে। গত দেড় মাসের শর্তহীন লকডাউনেও বিধি অমান্য করিয়া পুলিশের সহিত খণ্ডযুদ্ধ কম দেখে নাই এই রাজ্য। কিন্তু এই বেপরোয়া মনোভাব সাহসিকতার পরিচয় নহে, অপরিণামদর্শিতার পরিচয়। কারণ সঙ্কট কাটিয়াছে, এমন চিন্তা ভ্রান্ত। করোনা বিষয়ে একটি কথাই নিশ্চিত জানা গিয়াছে, তাহা এই যে সে বিষয়ে কিছুই নিশ্চিত জানা নাই। ভাইরাস নিজের গঠন কত দ্রুত বদলাইতে পারে, তাহার প্রতিরোধ জন্মাইলেও কত দিন তাহা কার্যকর থাকে, পুনরায় সংক্রমণ সম্ভব কি না, সকলই অনিশ্চিত। চিনের উহানে ফের রোগ ছড়াইবার খবর মিলিয়াছে, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস ছড়াইতেছে, নিত্য নূতন লক্ষণ পরিস্ফুট হইতেছে। অতএব মারণরোগ সদা জাগ্রত, সর্বত্র উপস্থিত, তাহা ধরিয়াই বাঁচিতে হইবে। মারি লইয়া ঘর করিবার ইহাই উপায়।
বেদনার কারণও এইখানে। নাগরিকের স্বাধীনতা সুরক্ষা করিবার কাজটিই রাষ্ট্রকে তাহার বিশিষ্ট স্থানটি দিয়াছে। তাই মনে হইতে পারে, দেশবাসীর স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরিয়া নিয়ন্ত্রিত হইবে, কেবলই বিধির উপর বিধি চাপিবে, ইহা কি গ্রহণযোগ্য? প্রশ্নটি অস্বাভাবিক নহে, কিন্তু তাহার উত্তরও স্পষ্ট। গণতন্ত্রে স্বাধীনতার অর্থ পরস্পরের অধীনতা। অপরের কল্যাণচিন্তা, অপরের জীবনের সুরক্ষার তাগিদের দ্বারা আমার সিদ্ধান্ত পরিচালিত করিতে হইবে, যেমন আমার সুরক্ষা ও কল্যাণকামনা থাকিবে অপরের চিন্তার কেন্দ্রে। মহামারি প্রতিরোধের যে নীতি, তাহার শক্তির উৎস মানুষের সহিত মানুষের বন্ধনে, কেবল সরকারি শাসনে নহে। কর্মময় জীবনে ফিরিবার মুক্তির আনন্দকে ভোগ করিতে হইলে যথেচ্ছাচারের তাগিদকে ত্যাগ না করিয়া উপায় নাই। লকডাউনের অন্তে বিধি মানিবার অনুজ্ঞা তখনই কার্যকর হইবে, যখন তা আসিবে সহনাগরিকের জন্য উদ্বেগ হইতে। নিজেকে বাঁচাইতে হইলেও আজ প্রতিবেশীকে বাঁচাইতে হইবে।