ছবি: সংগৃহীত
এ ই দুনিয়াব্যাপী নব্য দক্ষিণপন্থার যে ছবি কাল এঁকেছিলাম (‘দুনিয়া জুড়ে দক্ষিণ-উত্থান,’ আবাপ, ১-১), সেই প্রসঙ্গে গণপ্রতিবাদ ও বামপন্থী প্রতিবাদের সীমা ও ব্যর্থতার প্রশ্নও ওঠে। প্রশ্নের উত্তরটা পুরনোই। বামপন্থী ব্যর্থতার আয়নায় দক্ষিণপন্থী উত্থানের চেহারা স্পষ্ট হয়। শ্রমিকদের চরিত্র ও শ্রমপদ্ধতি বোঝা যায় পুঁজির চরিত্রের অবয়বে। সামরিক কলাকৌশল ও পদ্ধতিতে চেনা যায় নাগরিক সমাজের ভবিষ্যৎ। বুঝে নেওয়া যায়, যে সঙ্কট আমাদের পুরনো ধ্যানধারণা, সংজ্ঞা ইত্যাদিকে সমস্যায় ফেলেছে, সেই সঙ্কটই দক্ষিণপন্থী রাজনীতির নতুন আগ্রাসী পথের নির্দেশ দিয়েছে। অন্য দিকে, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ এবং সমাজ রূপান্তরের নতুন পথেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই দক্ষিণপন্থাকে না বুঝলে বামপন্থা বোঝা যাবে না, আবার বামপন্থার বর্তমান অবস্থা না বুঝলে এই নতুন আগ্রাসী শক্তির চরিত্র অনুধাবন করা যাবে না।
ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত— সর্বত্র রাজনীতিতে জনবাদী অথবা জনপ্রিয়তাবাদী ধাঁচের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সর্বত্র বামপন্থীদের কাছে অমোঘ সমস্যা অথবা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এই জনবাদী বা লোকবাদী রাজনীতি এবং দৃষ্টির অনুকূলে নিজেদের পথকে কতটা ঘোরানো যাবে? নতুন ধরনের দক্ষিণপন্থী সাধারণ ক্ষমতা, যা সর্বত্র আগ্রাসী রূপ নিচ্ছে, তার ধারণাগত ভিত্তিকে কতটা দুর্বল করা যাবে? লোক, জনকল্যাণ, লোকহিতবাদ, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি, জাতি এবং ঐক্য সম্পর্কে এক অন্য ধারণা, অর্থনীতি সম্পর্কে এক অন্য চিন্তা— এই সব উপাদানকে কী ভাবে নতুন রাজনীতির আঙ্গিকে আনা যাবে?
প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের ভগ্নদশা, নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সামাজিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাঝে দুস্তর প্রভেদ, গণতন্ত্রের সামরিকীকরণ, সমাজের মধ্য থেকে উঠে আসা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দাবি, অধিকারের চেয়েও ন্যায় এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা। সর্বত্র একই আশা: পথই পথ দেখাবে। অথচ, পথে নেমে পথভ্রান্ত হওয়ার, আইনব্যবস্থার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এ দেশেও পথের রাজনীতি এবং সংসদীয় রাজনীতির মাঝে তফাত বাড়ছে। বাড়ছে সংসদের কণ্ঠস্বর এবং পথের কণ্ঠস্বরের মাঝে প্রভেদ। আইন এবং বিচারব্যবস্থার মৌন আরও গভীর হচ্ছে সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক বিভেদ, নিপীড়ন এবং একনায়কতন্ত্রের বাস্তবতার সামনে। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ‘সামাজিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা’র কোনও স্থান থাকছে না। নয়া সংবাদমাধ্যম, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সামরিকীকরণ, আইনের অনুশাসনের উপর এমন জোর যেখানে ন্যায়বিচারও গৌণ হয়ে পড়ে, নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক সংস্কার, শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের আয় হ্রাস এবং জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষা সঙ্কোচন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং সমাজের বিভিন্ন বিভেদরেখাকে ব্যবহার করে নতুন ধরনের এক সাধারণ ক্ষমতার নির্মাণ যা জাতিবোধকে পরিণত করে উগ্র জাতীয়তাবাদে— এই সব বৈশিষ্ট্য আজ ভারতবর্ষে প্রকট।
এই নতুন শাসনের অর্থনৈতিক ভিত্তিও বিশ্বব্যাপী এক ধাঁচের প্রতিফলন। এক দিকে অর্থকরী পুঁজি, অন্য দিকে ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ এবং শ্রমিকদের আদিম পুঁজি সঞ্চালনের প্রক্রিয়ায় নিয়োগ, সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু পরিকাঠামো নির্মাণ; বেসরকারিকরণ এবং বৈদেশিক বা নিজের উপর গুরুত্ব এবং পুঁজিকে উন্মাদের মতো সচল করে তোলা— এই সব বৈশিষ্ট্য এ দেশেও লক্ষণীয়।
এই ধরনের দক্ষিণপন্থী পরিমণ্ডলের বাইরে যে কোনও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উদ্যোগই ঘোষিত হবে বেআইনি বলে। আইন এবং আইনের বাইরে যে বিশাল সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতির পরিসর— এই দুইয়ের মাঝে সঙ্কট আজ দেশের পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করেছে। ব্রাজিল, ফ্রান্স, আমেরিকা— সর্বত্র এক প্রয়াস— আইনকে কী ভাবে কর্তৃত্ববাদী দক্ষিণপন্থী শাসনের স্তম্ভ করে তোলা যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাই বিস্ময়কর নয়।
অন্য দিকে জনবাদী সমাবেশেরও একটা ধাঁচ ক্রমশ পরিস্ফুট হচ্ছে। এই সমাবেশ নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু লুলার প্রত্যাবর্তন, প্যারিসের রাজপথে হলুদ বর্ম পরিহিত সহস্র সহস্র প্রতিবাদী মানুষ— এই রকম জনবাদী সমাবেশের দৃঢ়তা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আগামী দিনের রাজনৈতিক সংগ্রামের ভাগ্য নির্ধারিত করবে। বামপন্থীদের চোখ খুলে দেবে নতুন পথের দিকে।
২০১৯ হয়তো এক অন্তর্বর্তী অধ্যায়। সংহার পর্ব অথবা নির্মাণ পর্ব— যে নামেই আসন্ন ভবিষ্যৎকে চিহ্নিত করুন, বিশ্বব্যাপী নব দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং তার পাশাপাশি জনবাদী বা লোকবাদী রাজনীতি ও সমাবেশের প্রসার এক চূড়ান্ত সংঘর্ষের পথে যাচ্ছে। এই সংঘর্ষে অথবা সমুদ্র মন্থনে বহু কিছু তলিয়ে যাবে, যেমন প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র এবং আইন সম্পর্কে সাবেকি ধারণা; তেমনই নতুন অনেক কিছুই উঠে আসবে এই মন্থন থেকে। জাতিবোধ, সংহতি, জনবাদী বা প্রতিবাদী সংবিধানবোধ, অন্য ধরনের অর্থনীতির ভাবনা, নেতৃত্বের পথ, বহু উপাদান সমন্বিত এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা, সংলাপী রাজনীতির প্রসার এবং পৃথিবী সম্পর্কে এক অন্য কল্পনা— এক কথায় এক নতুন রাজনৈতিক আত্মিকতা। দার্শনিকের ভাষায় ‘পলিটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি’ বা রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা। এই রাজনৈতিক বোধ জন্ম দেয় নতুন রাজনৈতিক সত্তার।
একে কি কল্পস্বর্গ রচনা বলবেন? সম্ভবত তা-ই। তবু বলব, প্রতিটি কল্পস্বর্গের সিঁড়িতেই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ থাকে। হয়তো, আজকের এই বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলাকে এক অন্তর্বর্তীকালীন অধ্যায় হিসাবেই চিহ্নিত করা যায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ