প্রতীকী ছবি
লকডাউনের সময়ে পথেঘাটে ঘুরিয়া বেড়ানো এক নাগরিককে ‘স্বগৃহে’ পাঠাইবার চেষ্টা করিয়াছিল রোম শহরের পুলিশ। জানা যায় যে তিনি গৃহহীন, পথই তাঁহার আবাস। গৃহ নাই বলিয়া গৃহ-নিভৃতবাসের নিয়ম মানিবার সাধ্যও তাঁহার নাই। ঘটনাটি উত্থাপন করিয়া পোপ ফ্রান্সিস বলিয়াছেন, এই সভ্যতায় দরিদ্র ব্যক্তি আর মানুষ নহে, কেবল বস্তু। বস্তু বলিলেও বেশি হয়, তাঁহারা এখন ভূপ্রকৃতির অংশমাত্র। ইহার মূল কারণ, দারিদ্রকে লজ্জাকর ভাবিয়া আমরা ঢাকিয়া রাখিয়াছি, অবহেলা আর অবজ্ঞা করিয়াছি। বুঝি নাই যে উহাতে কোনও লজ্জা নাই, লজ্জা আছে উহাকে গোপন করিবার ভিতর। তাহাদের প্রয়োজনের কথা ভাবি নাই। তাহাদের কষ্ট দূর করিতে আগাইয়া আসি নাই। এই সূত্রে ফিয়োদর দস্তয়ভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে কারা হাসপাতালের এক দরিদ্র রোগীর সংলাপটি পোপ স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন: ‘তাঁহারও এক জন মা ছিল!’ মানবসমাজের বর্তমান দৈন্যের কারণ এই মানবিক উপলব্ধির অভাব।
কিন্তু উপলব্ধি করিবে কে? সমাজকে নেতৃত্ব দেন যাঁহারা, সেই নেতাদের ভণ্ডামির শেষ নাই। নেতাদের দ্বারা যাঁরা চালিত হন, সেই নাগরিক সমাজেরও স্বার্থপরতা সীমাহীন। সমাজের উচ্চ ও মধ্য শ্রেণি নিজেদের লইয়া এতই ব্যতিব্যস্ত, নীচের তলার খোঁজ লইবার সময় কিংবা ইচ্ছা তাঁহাদের নাই। ভারতের উদাহরণ লওয়া যাউক। লকডাউনে এ দেশের দরিদ্র জনসাধারণ কী অবস্থায় পড়িয়াছেন, তাহার সঠিক সংবাদ জননেতাদের কাছে আছে কি না, ঘোর সন্দেহ। শ্রমিকদের দুর্দশা হইতেই নেতৃত্বের এই অপরিসীম অবজ্ঞা স্পষ্ট। অথচ শ্রমিকদের যে কেবল উপার্জন লইয়া টানাটানি পড়িয়াছিল তাহা নহে, মাথা গুঁজিবার আশ্রয়টুকুও অনেক ক্ষেত্রে ছিল না, পরিবারের সহিত সকল সংযোগ বিনষ্ট হইয়াছিল। যে অসুখে বিশ্ব আজ বিধ্বস্ত হইয়াছে, তাহাতে আক্রান্ত হইলে এই মানুষগুলির কী হইতে পারে, ভাবিলেও আতঙ্কিত হইতে হয়— কোভিড আসিয়া আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার, অর্থাৎ গরিবদের সুরাহার একমাত্র উপায়ের কঙ্কালটি এমন ভাবেই বাহির করিয়া দিয়াছে। বুঝাইয়া দিয়াছে উন্নয়নের নামে প্রত্যহ উপর্যুপরি দাবি পেশ হয়, প্রতিরক্ষা খাতে প্রতি বৎসর বরাদ্দ বাড়ে, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের কথা জননেতাদের স্মরণে থাকে না। দরিদ্রের ভোট তাঁহাদের কাছে জরুরি, কিন্তু দরিদ্রের প্রতি তাঁহাদের অনীহা সেই বিষম প্রয়োজন দিয়াও নিশ্চিত করা যায় না।
সঙ্কটকালে দৃষ্টি অনেক পরিষ্কার হয়, অনেক সত্য উলঙ্গ হয়। পোপ ফ্রান্সিস স্পষ্ট করিয়া সেই সত্যকেই প্রকাশ করিলেন। বিশ্বময় জননেতারা কি তাঁহার মূল্যবান কথাগুলি শুনিতে পাইলেন? এই অভূতপূর্ব বৈশ্বিক বিপদ কি দেশে দেশে নেতাদের কিছুমাত্র শিখাইল? ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থপাশ খুলিয়া বৃহৎ রাজনীতির দিকে কিছুমাত্র ঠেলিয়া দিল? কোভিড-যুগ দেখাইয়া দিয়াছে, সম্পন্ন সমাজ হইতে অভাবী সমাজে সংক্রমণ ছড়াইবে, দরিদ্র মানুষের অসুস্থতা ধনী সমাজের বিপন্নতা আনিবে। একে না বাঁচিলে অন্যে বাঁচিবে না। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া মানুষ থাকিবে না। সভ্যতার ভবিষ্যৎ এই পারস্পরিকতার উপরই নির্ভর করিতেছে। মানুষ যদি মানুষের উপর বিশ্বাস রাখিতে না পারে, তাহা হইলে শেষে কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না, থাকিবে শুধু সভ্যতার স্মৃতি।