Cow

চতুষ্পদী বৃত্তান্ত ও অর্থনীতি

উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বলেছেন, খেত না বাঁচলে গোমাতাদের তাড়িয়ে স্কুল, কলেজ, অফিসে ঢুকিয়ে দেবেন।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০১
Share:

এই বছরই মার্চ মাসের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী যোগীজির রাজ্যের পাঁচ কোটি কুড়ি হাজার গরু, মোষ আধার কার্ড পেয়ে যাচ্ছে। ‘গরু’ বললে অবশ্য ওদের মানহানি হয়। ‘গোমাতা’ বলাই বিধেয়। সেই হিসেবে ষাঁড়দের ‘গোবাবা’ বলতে হবে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। তা সেই গো-বাবা-মায়েদের মধ্যে ছেষট্টি লক্ষ মাতা এবং সাতষট্টি লক্ষ পিতা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর-যুক্ত ইলেকট্রনিক চিপওয়ালা হলুদ কার্ড। কার্ড ট্র্যাক করলেই পাওয়া যাবে তাদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য। কোথায় থাকে, কোথায় ঘাস বা খড় দিয়ে লাঞ্চ, ডিনার ইত্যাদি সারে, বংশপরিচয় কী, কত লিটার সোনা থুড়ি দুধ দেয়, প্রতিপালকের ফোন নম্বর— সব এখন ডিজিটাল উত্তরপ্রদেশের হাতের মুঠোয়।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশে গরুপালকের সমস্যা মাঝনদীতে ভাঙা সেতুর উপর ট্রাপিজ়ের খেলোয়াড়ের মতো। দুধ দেওয়া বন্ধ হলে মা’দের নিয়ে সন্তান বিভ্রান্ত। গোমাতাকে বিক্রি করলে গো-রক্ষকের আক্রমণ অবধারিত। কোথাও নিয়ে যাওয়ার পথে যদি রক্তচোখ রক্ষকদের পাল্লায় পড়েন, কেটেকুটে কিমা করে রেখে দেবে। আইনরক্ষকরা হত্যাকারীকে খুঁজেই পাবেন না। কেস করা হতে পারে নিহতের উপরেই। ‘ধর্মরক্ষা’ বলে একটা ব্যাপার আছে না? ‘ধর্ম’-এর উপরে তো আর আইন নয়? এই ধর্ম তো আর আপনার-আমার মতো সাধারণের ধারণ-সম্পদ নয়, এ হল দেশভক্তদের ব্যাপার। গত কয়েক বছরে গোমাতাকে রক্ষার জন্য মানবসন্তান পেটানোর ঘটনা সত্তর শতাংশের উপর বৃদ্ধি পেয়েছে।

‘কাউ-স্লটার প্রিভেনশন অর্ডিন্যান্স, ২০২০’ জারি করে উত্তরপ্রদেশ সরকার গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণের পথে অন্য রাজ্যগুলির দিগ্‌নির্দেশক হিসেবে নেমে পড়েছে। প্রশ্ন হল, দুধ দেওয়া বন্ধ করলে সেই গরু নিয়ে প্রতিপালক করবেন কী? হত্যা করা চলবে না। গরু অনাহারে থাকলে মালিকের কারাদণ্ড। ফলে গোমাতাদের রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে মালিক পিটটান দিচ্ছেন। হাড়জিরজিরে গোমাতা-পিতারা খেতের পর খেত ধ্বংস করছে। চাষিরা রাত জেগে খেত পাহারা দিচ্ছেন কনকনে শীতের রাতেও। জারি করছেন অঘোষিত গো-কার্ফু।

Advertisement

শুধু গ্রামাঞ্চলে খেতখামার নয়, মফস‌্সল বা শহরের পথেঘাটেও মাঝেমধ্যে গো-বাহিনী হানা দিচ্ছে। বছর তিনেক আগে ফৈজাবাদের কাছে ঐতিহাসিক জ্যামে ২৮ নম্বর জাতীয় সড়ক একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল: অনাথ গরুরা যাতায়াত করছিল। ২০১৭ সালে বলরামপুরে আইনরক্ষকদের জিপ তাই গো-রক্ষা করতে গিয়ে উষাদেবী নামে এক প্রৌঢ়ার শরীরের উপর উঠে পড়েছিল। তিনি পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন— ‘ধর্ম’ রক্ষা হয়েছিল।

সরকারের তো রাতের ঘুম চলে যায় অনাথ গোমাতাদের দুর্দশা দেখতে না পেরে। নানা পরিকল্পনা হল। যেমন, থানায় থানায় গোমাতা। অর্থাৎ, কয়েদি ছেড়ে পুলিশ গো-সেবা করবে। সরকার গো-সেবকদের আর্থিক ও অন্য গো-সম্পর্কিত সুবিধা দেবে, এমনও বলা হল। দুষ্টু অর্থনীতিবিদ আর নিন্দুকের দল বললেন, মানুষের জন্য টাকা জোটে না, না-মানুষের জন্য জুটবে কোথা থেকে? এ বার এল গো-সেস, গো-টোল ইত্যাদির প্রস্তাব। গোশালা তৈরি হল। সেখানে অনাথ গরুরা আশ্রয়, খাওয়াদাওয়া সব পাবে। ক্রমে তার টাকা আসাও বন্ধ হল। মহান পঞ্চায়েত প্রধানরা এ বার হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। গোমাংস, চামড়া ইত্যাদির ব্যবসা নিয়ে ভারত অনেক এগিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাজার রীতিমতো ভাল। সে বাজারের কী হবে? গো-আশ্রমও ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছে। নিন্দুকে বলে, বহু গোমাতা দেহ রাখছে। সরকারি তরফে দাবি করা হয়েছে, মৃত্যুর কারণ ‘অনাহার’ বা ‘অপুষ্টি’ নয়। ও সব ‘ন্যাচারাল ডেথ’, অথবা গরুদের ‘কো-মর্বিডিটি’ ছিল।

বিষয়টি হালকা নয়। কারণ উত্তরের হাওয়া বাদবাকি ভারতেও বইতে শুরু করেছে। কর্নাটক তো একই রকম আইন করে ফেলেছে। যে জীবে প্রেম থাকলে ঈশ্বরের সেবা হয়, তার তালিকায় গরুও রয়েছে। গৃহপালিত পশু হিসেবে তার প্রতি আমাদের, বাঙালিদেরও এক অন্য রকম একাত্মতা আছে। সত্যি বলতে কী, মৃত মহেশের ফেলে যাওয়া দড়ির পাশে বসে চোখের জল ফেলেনি এমন কোনও গফুর বা আমিনা আমাদের চেনাজানায় নেই। তবু বাস্তব এবং বিজ্ঞানকে তো অস্বীকার করা চলে না। ‘খাদ্যশৃঙ্খল’ বিষয়টিকেও বাতিল করা চলে না। যে দেশে বৃদ্ধ মা, বাবাকে অচেনা স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে বা ঘরে তালা দিয়ে ছেলেমেয়ে পালায়, যে দেশের অনেক বৃদ্ধাবাসেই চরম অযত্নে থাকেন আমাদের অভিভাবকরা, সেখানে অর্থনীতির প্রাসাদে বড় ঘরটি কি মানুষেরই প্রাপ্য নয়?— অর্থনীতি পছন্দের নীতি। অল্প সঙ্গতিতে কোন বিকল্পটি বেছে নেব, তার উপর দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে। সেই নীতির ঘাড়ে যদি বিজ্ঞানকে সরিয়ে অন্য উদ্দেশ্য চেপে বসে, তখন পছন্দ বদলে যায়। উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বলেছেন, খেত না বাঁচলে গোমাতাদের তাড়িয়ে স্কুল, কলেজ, অফিসে ঢুকিয়ে দেবেন। তেমন দিনের অপেক্ষায় কি রয়েছি আমরা?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement