Bengalis

ধিক

বাঙালির কর্তব্য নিজেকে প্রশ্ন করা, এই স্পর্ধিত উচ্চবর্ণ পুরুষতন্ত্রের বহিরাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কি সে বাংলার মাটিতে স্থান দিবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৪৩
Share:

ভাবাবেগে আঘাত বস্তুটি চরিত্রে বায়বীয়, ফলে তাহাকে দেখিবার উপায় নাই। এই আঘাত কেবলমাত্র অনুভূত হয়। পূর্বে গোটা দুনিয়ারই দস্তুর ছিল, যে জনগোষ্ঠী যেখানে সংখ্যালঘু, সেখানে তাহাদের ভাবাবেগেই আঘাত লাগে। কারণ, সংখ্যালঘু হইবার কারণে যে অনিশ্চয়তা, তাহা বিপন্নতার বোধকে তীব্রতর করে, এবং সেই বোধ হইতেই ভাবাবেগে আঘাত অনুভূত হয়। তাহা হইলে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবাবেগ এত ঘন ঘন আহত হইতেছে কেন? বিশেষত, দেশের শাসকপক্ষ যখন ঘোষিত ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি ঝুঁকিয়া আছে, তখন এই আঘাতের কারণ কী? কারণটি সহজ— সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে সংখ্যালঘুসুলভ বিপন্নতার বোধ জাগাইয়া রাখিতে পারা, এবং সেই বিপন্নতাকে ‘অপর’-এর বিরুদ্ধে আক্রমণের অস্ত্র করিয়া তোলা সংখ্যাগুরুবাদের ধর্ম।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি এক অভিনেত্রী জানাইয়াছিলেন, তিনি নিরামিষাশী হইলেও গোমাংস রাঁধিয়া দিতে তাঁহার কোনও আপত্তি নাই। হিন্দুত্ববাদীদের ভাবাবেগ তাঁহার বক্তব্যে আহত হইয়াছে। যে গোমাংস স্পষ্টতই আজও হিন্দু সমাজের কিছু কিছু অংশের স্বাভাবিক খাদ্য, তাহার উল্লেখমাত্রে যাহাদের আবেগ আহত হয়, তাহারা কোন পরিচিতির রাজনীতি করিতেছেন, আপাতত সেই প্রশ্নটি মুলতুবি থাকুক। ঘটনা হইল, এই আবেগাহতরা অভিনেত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়াছেন। অভূতপূর্ব বলা চলে। এত দিন পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসর বহু দোষে দুষ্ট হইলেও কাহারও খাদ্যাভ্যাসের কারণে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া এই রাজ্যে দস্তুর ছিল না। শুধু গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসই নহে, যে কোনও প্রশ্নে নারীর বিরোধিতা করিতে হইলেই তাঁহাকে ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার হুমকি দেওয়া, এবং বহু ক্ষেত্রেই কাজটি করা— ইহা আপাতত এক ধরনের রাজনীতির ধর্ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নারীকে একটি সম্পূর্ণ অস্তিত্ব হিসাবে স্বীকার করিবার অভ্যাস সেই স্পর্ধিত পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির নাই। নারীকে শাস্তি দিবার পথ তাহাকে যৌন নির্যাতন করা, কারণ পুরুষতন্ত্রের নিকট হেঁশেলের বাহিরে নারীর অস্তিত্ব যোনিতেই সীমাবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গে অভিনেত্রীকে ধর্ষণের হুমকিটি, অতএব, কোন আইটি সেল কর্তৃক সূচিত, সেই প্রশ্নে ঢুকিবার প্রয়োজন নাই— হুমকিটি চরিত্রগত ভাবেই গোবলয়ের উদ্ধত হিন্দুত্বগন্ধী।

অর্থাৎ, তাহা মূলগত ভাবে ‘অবাঙালি’। হুমকিটি কোন প্রদেশের, কোন ভাষাভাষী লোক দিয়াছেন, প্রশ্নগুলি অবান্তর। ইহা ‘অবাঙালি’, কারণ চরিত্রগত ভাবে এমন হুমকি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গ নহে। সেই কারণেই বর্তমান হুমকিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। যাহারা অভিনেত্রীকে এই কদর্য হুমকি দিয়াছে, পুলিশ-প্রশাসনের কর্তব্য তাহাদের চিহ্নিত করিয়া শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু, জাতিগত ভাবে আরও একটি দায়িত্ব বাকি থাকে। আত্মসমীক্ষার দায়িত্ব। বাঙালির কর্তব্য নিজেকে প্রশ্ন করা, এই স্পর্ধিত উচ্চবর্ণ পুরুষতন্ত্রের বহিরাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে কি সে বাংলার মাটিতে স্থান দিবে? এক্ষণে দুইটি কথা স্মরণে রাখা বিধেয়। এক, নবজাগরণ হইতে দেড়শত বৎসরেরও অধিক সময়ের সাধনায় যে বাঙালি সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে, গোবলয়ের বিদ্বেষী রাজনীতির নিকট সেই পরিসরটিকে এক বার ছাড়িয়া দিলে তাহা পুনরুদ্ধার করা অতি দুষ্কর। দুই, উদার সমন্বয়বাদী হিন্দু সংস্কৃতির বিপরীতে এই উদ্ধত হিন্দুত্ববাদ যে হেতু চরিত্রগত ভাবেই ‘অপর’-বিদ্বেষী— অর্থাৎ, এই রাজনীতির সর্ব ক্ষণই শত্রুর প্রয়োজন হয়, এবং শত্রু নির্ধারিত হয় পরিচিতির মাধ্যমে— কাজেই, আজ যাঁহারা এই রাজনীতির অনুকূল প্রান্তে অবস্থান করেন, আগামী কাল যে তাঁহারাও কোনও পরিচিতির কারণে শত্রু প্রতিপন্ন হইবেন না, তাহার ভরসা নাই। এমন এক-একটি ঘটনা বিপদের পরিমাণ বুঝাইয়া দিতে যথেষ্ট।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement