রেশন নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি জমে উঠেছে। ওঠার কথাও। সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সমস্যা হল, স্বার্থ বা আর্থিক লাভের গন্ধ পেলেই তা ঝাঁপিয়ে পড়ে! এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। করোনার কবলে বিশ্বে চলেছে মৃত্যুমিছিল। করোনার প্রকোপে পরিবেশবিদেরাও ভীত নিশ্চিত, তবে বহিরঙ্গে খুশি। তাঁরা বলছেন, লকডাউনে পরিবেশদূষণ অনেক কমে গিয়েছে। পৃথিবীর আয়ু বেড়ে গিয়েছে। করোনা হয়ে উঠেছে সাম্যবাদীও। এই মারণ ভাইরাসের দাপটে জাতি ধর্মের আস্ফালন শেষ! সকলে আজ এক সঙ্গে মিলেমিশে করোনার বিরুদ্ধে সামিল। তাঁরা আশাবাদী, আগামী দিন হবে মানবতার।
এরই মধ্যে বেশ কিছু রাজনীতিক আর কিছু রেশন ডিলারের আনন্দ আর ধরছে না! লকডাউন হওয়ার পরই চারদিকে শুরু হল দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের হাহাকার। প্রথম দু’চারদিন কোনওক্রমে কেটে গেলেও তারপর কয়েকটি বিষয় কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারকে চতুর্মুখী লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে। প্রথমত, করোনাকে প্রতিহত করা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে সরকারকে মুক্ত রাখা। তৃতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যার মেটানো। চতুর্থত, ঠিক ভাবে গরিব মানুষের ঘরে রেশন পৌঁছে দেওয়া। এই চারটি বিষয় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কাদা ছোড়াছুড়ি যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে তা বিবৃতির মধ্যে থেমে আছে।
কিন্তু রেশন বণ্টন? এই বিষয়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা পথে নেমে পড়েছেন। এর পিছনে দু'টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, গরিব মানুষের জন্য এঁদের 'দরদ', যা প্রদর্শন করা রাজনৈতিক কারণেই জরুরি। দ্বিতীয়ত, কোনও সহমর্মিতা নয়, রেশন বিলিতে নিজেদের স্বার্থপূরণ করা। লকডাউনের একেবারে প্রথম পর্যায়ে গরিব মানুষের ঘরে খাদ্যসামগ্রী যাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই কোনও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সে ভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হওয়া মাত্রই এঁদের মধ্যে সক্রিয়তা চোখে পড়তে দেখা গেল। অনেক রাজনৈতিক নেতাই সক্রিয় এই বিষয়ে।
রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয়তায় নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষের মনে তৈরি হয়েছিল আশা। খাদ্যসামগ্রী হয়তো এ বার যথাযথ ভাবে মিলবে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হল? সুচারু ভাবে বণ্টন হল না। অনেক জায়গায় মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠছে যে, কিছু রাজনৈতিক নেতা তাঁদের আখেরই গোছাচ্ছেন রেশন ব্যবস্থায় সক্রিয় হয়ে। যে কারণে নাকি রেশন-অনিয়মে কিছু ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ নেই। ভোক্তা খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছেন না, তার কোনও নজরদারি নেই। অথচ, নেতানেত্রীরা যদি গরিব মানুষের কথা ভেবে সত্যি সক্রিয় হতেন, তা হলে রেশন-ব্যবস্থায় এত অরাজকতা দেখা যেত না। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা খুব ভাল ভাবেই জানেন যে, ভোটের সময় এই মানুষগুলোকেই তাঁদের প্রয়োজন হয়। এই সাধারণ মানুষদের মধ্যেই অনেকে এই রাজনৈতিক নেতাদের পোলিং এজেন্ট হয়ে বুথে বসে থাকেন।
এ দিকে রেশন ডিলারের লাভ আর চাপ দুই সমান তালে চলছে। রেশন ডিলাররাও সুযোগের অপেক্ষায় থাকছেন, যদি রেশনের চাল, গমে একটু গুণগত মানের হেরফের করা যায় কিংবা ওজনে কম দিয়ে অতিরিক্ত কিছু আয় করা যায়। এই লাভ আর চাপের মধ্যে অনেকে অপদস্থও হচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যেই কুপন আর গোপন রেশনকার্ড নিয়ে মাফিয়াচক্র সক্রিয় হয়েছে। এরা ঘরে বসে বিশাল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছে বলে শোনা যাচ্ছে।
যাঁরা মনে করেন যে, করোনার বিপদ কেটে গেলে মানুষের মনে নতুন করে মানবতাবোধ তৈরি হবে এবং আগামী দিনে এক নতুন বিশ্ব আমরা পাব, তাঁদের এই আশা যে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। রেশন বণ্টনের এই বেনিয়ম ও অব্যবস্থার ছবিই তৈরি করছে হতাশা!
সরকার যেমন জনগণকে সাহায্য করতে চাইছে, তেমনই তার সুফল নিজের দলের দিকে টেনে নিতে চাইছেন কিছু রাজনীতিক। এই দু’ধারা চালাতে গিয়ে মুলধারা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ খাবার পাচ্ছেন না। পাশাপাশি রাজনীতি চলছে তার নিজের মতো!
এই যে রেশন দেওয়া নিয়ে নানা কথা নানা সমস্যা রাজনীতির ময়দানকে গরম করছে, এর থেকে বেরনোর কি কোনও উপায় নেই? সঙ্কটে কীসের? রেশনকার্ড? কুপন? যাঁর দরকার, তিনি এসে রেশন নিয়ে যান। ভোটার কার্ড দেখে বুথভিত্তিক রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। সব দলের লোকেরা থাকুন। কার পরিবারে কতজন আছেন, সেই হিসেব নেওয়ার জন্য রেশনকার্ড বা আধারকার্ড দেখে রেশন দেওয়া হোক। এতে যদি দু’চারজন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন নিয়ে যেতে চান, যাবেন। এতে হয়তো বর্তমান বরাদ্দ থেকে আরও কিছু পরিমাণ বেশি সরবরাহ করতে হবে। তবে সকলে এই লাইনে দাঁড়াবেন বলে মনে হয় না। সামাজিক সংগঠনগুলিকে যুক্ত করলে আরও ভাল হবে। রাজনীতি হোক, কিন্তু গরিব মানুষের খাবার নিয়ে রাজনীতি সাধারণ মানুষ মোটেই ভাল ভাবে নেবেন না, নিচ্ছেন না।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)