মহাভারত’-এ ‘গীতা’ যে প্রক্ষিপ্ত, সে বিষয়ে বিশ্বের মহাভারতবিদরা মোটামুটি একমত। আমার কাছে পাঠক হিসেবে ‘গীতা’র স্থাপন বিস্ময়কর। ‘মহাভারত’-এর কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষ যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তখন ‘মহাভারত’-এর শ্রেষ্ঠ বীর অর্জুন তঁার সারথিকে বললেন, দুই সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে আমার রথ স্থাপন করো। সেই প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘অর্জুনবিষাদযোগ’। মহাবীর অর্জুনের বিষাদ: কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ? আমারই বিরুদ্ধে? সত্যিই, এমন বিষাদের উচ্চারণ ছাড়া সেই যুদ্ধ শুরু হতে পারে কি, যে যুদ্ধে অর্জুন তাঁর মহাবীর পুত্র অভিমন্যুকে বাঁচাতে পারেন না? তাই যুদ্ধের শুরুতে দুই সেনাদলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা তাঁর নিজেকেই: কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? আমারই বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ!
কথাটা মনে এল জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের পর প্রধানমন্ত্রীর জাতির প্রতি ভাষণ থেকে। নরেন্দ্র মোদী বললেন, তিনি তো আছেন, তিনি আবার কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন। কাশ্মীরকে ভারতের শিরোমণি করে তুলবেন, কাশ্মীরে সিনেমার শুটিং হবে, কর্পোরেট বিনিয়োগ হবে, কত হোটেল হবে, কাশ্মীরের জমি যে কেউ কিনতে পারবে। কাশ্মীর, ভারত হয়ে যাবে। হয়ে গেলে, ‘আমি’ কাশ্মীরকে আবার রাজ্য করে দেব। একটাই মাপকাঠি— তিনি যাকে ভারত মনে করেন, কাশ্মীরকে সেই ভারত হয়ে উঠতে হবে।
‘অর্জুনবিষাদযোগ’-এর পর সারথি অনেক ‘যোগ’-এর কথা শুনিয়েছিলেন অর্জুনকে। কর্মযোগ, ভক্তিযোগ। কার সঙ্গে যোগ? ঈশ্বরের সঙ্গে। ঈশ্বরাধিক এক পরমের সঙ্গে। সেই যোগের জন্যই এ যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধে পরিণত করতে হবে। সারথি অর্জুনকে শর্ত দিলেন— আনুগত্য বা দাসত্ব। ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাম্ সর্বপাপেভ্যো রক্ষয়ামি মা শোচ।’ রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় এই ভাষাতেই বললেন, ‘‘শুধু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিশ্বাস রাখুন।’’ কিন্তু যে এতগুলো যোগ সারথি বাতলালেন, তার সঙ্গে প্রথম যোগটির সম্বন্ধ কী? ‘অর্জুনবিষাদ’ কার সঙ্গে যুক্ত করবে তাঁকে? সেই বিষাদ ‘মামেকম্’ ও ‘অহম্’-এর সঙ্গে অর্জুনকে যুক্ত করবে কী করে? বিষাদ তো পাপ নয়।
আজকাল দেখছি ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে একক-কেন্দ্র ও ফেডারাল— এই দু’টি ধরনের রাষ্ট্রকাঠামোর একমাত্র উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এস আর বোম্মাই বনাম ভারতীয় ইউনিয়ন মামলায় বলেছিলেন, ফেডারালিজ়ম বলতে সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বোঝানো হয়। এই ধারণা থেকেই ভারতীয় ইউনিয়নকে ও তার সংবিধানকে ‘কোয়েজ়াই-ফেডারাল’ বলা হচ্ছে। এমন পরিভাষায় রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ণয় এর আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। আমেরিকায় স্টেটগুলো তো আগেই ছিল। তাদের স্বাধিকার ছিল নিঃসংশয়। বরং আমেরিকাকেই বলা যায় ‘কোয়েজ়াই-ফেডারাল’।
মনে পড়ে, একটা লেখার জিনিস কিনতে শিকাগোর কাছের একটা ছোট শহর থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল আর এক রাজ্যের দোকানে। সঙ্গীকে বললাম, একটা ফালতু জিনিস কিনতে এতটা তেল পোড়ালে? সে বলল, ‘‘না, আমাদের স্টেট ওয়ালমার্টকে দোকান খুলতে দেয় না, আর তেলটাই তো সবচেয়ে সস্তা।’’ একটা রাজ্য ওয়ালমার্টের মতো একটা কর্পোরেটকেও ‘না’ করে দিতে পারে। যাকে সংবিধানে রেসিডুয়ারি পাওয়ার বলে, আমেরিকায় তা রাজ্যগুলির আছে, কেন্দ্রের নেই।
আর ভারতে তো একটা একক (ইউনিটারি) সাম্রাজ্যের কাঠামোর মধ্যে নতুন রাষ্ট্র তৈরি হল। ফলে কেন্দ্রিকতা থেকে রাজ্যগুলিকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছিল। তিন ধরনের প্রদেশ ছিল: ‘এ’ বর্গের প্রদেশগুলি ছিল পুরনো প্রদেশ, ‘বি’-তে দেশীয় রাজ্য, ‘সি’— চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ। এই বাস্তবতাকে সংবিধানে বিন্যস্ত করতে হচ্ছিল। এখন দেখছি, কাশ্মীরের ঘটনার পর, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অ্যাসিমেট্রিক’ বলা হচ্ছে। এমন বলার মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে। যেন অসংহত যুক্তরাষ্ট্রকে সংহত করা হচ্ছে। মিডিয়ায় বিশেষজ্ঞদের কথা শুনেও মনে হচ্ছে, কাশ্মীরের ভারত হওয়ার পথে ৩৭০ ধারাই প্রধান বাধা ছিল।
এক বিদেশিনির বই ‘ফেডারালিজ়ম ইন ইন্ডিয়া’য় একটি তালিকা আছে— কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪-র আগেই ৯৩টি কেন্দ্রীয় বিধি ৩৭০ ধারার অন্তর্গত করেছিল। কোথাও তো কোনও আপত্তি হয়নি। কোন রাজ্যের জন্য পরিস্থিতিগত কারণে কত রকম বিশেষ ব্যবস্থা আছে তার একটা তালিকাও তৈরি করেছেন কে বেঙ্কটরমন ও সুমন্ত সেন। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশের রাজ্যপালদের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া আছে— রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করেই বিবেচনা অনুযায়ী রাজ্যপালরা সিদ্ধান্ত নেবেন। রাজ্যপালের বিবেচনা মানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ। ৩৭১ ধারা অনুযায়ী মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল বিদর্ভ, মরাঠাওয়াড়া ও রাজ্যের অন্যান্য অংশে আলাদা আলাদা উন্নয়ন পর্ষৎ গঠন করতে পারেন। গুজরাতের রাজ্যপাল একই অধিকার ভোগ করেন সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ ও রাজ্যের অন্যান্য অংশ সম্পর্কে। ৩৭১ক ধারা অনুযায়ী সংসদে গৃহীত (সম্পত্তি বা ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত) কোনও আইন নাগাল্যান্ডের বিধানসভার সম্মতি ছাড়া সে রাজ্যে প্রয়োগ করা যাবে না। নাগাল্যান্ডে প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুন বা প্রচলনগুলি সংবিধানে লিখিত ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৯৬০-এর জুলাই থেকে। ৩৭১খ ধারায় অসমের জনজাতি এলাকার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক। সেই ধারার প্রয়োগ থেকেই মেঘালয় রাজ্য তৈরি হয়। ৩৭১গ ধারায় মণিপুরের পার্বত্য এলাকা নিয়ে এবং ৩৭১ঘ ধারায় অন্ধ্রপ্রদেশ সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থার বিধান আছে। ৩৭১চ ধারায় সিকিমের অন্তর্ভুক্তির পর এমন বিশেষ ব্যবস্থা সংবিধানে তৈরি হয়। ৩৭১ছ ধারায় মিজোরাম, ৩৭১জ ধারায় অরুণাচল প্রদেশ সম্পর্কে সেই ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কাশ্মীরের ৩৭০-এর চাইতে এই সব ধারার অনেকগুলি আরও অনেক বেশি প্রাদেশিক। তাঁদের শর্তাধীন ভারত তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের স্বরাজ্য গুজরাতের, বা মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের বিশেষ ক্ষমতা খারিজ করুন না! যাঁরা মনে করছেন কাশ্মীর ৩৭০ ধারার সুযোগে ভারতের সঙ্গে মিলতে চায়নি, তাঁরা বরং ফেডারাল, ইউনিয়ন ইত্যাদির বিবরণ জানুন ও পড়ুন, কাশ্মীরে কী ঘটেছে বিচার করুন। কোনও এক স্বেচ্ছানির্বাসিত অবতারের মতো তাঁর কাছে আমরা পরশুরামের গল্পের সেই ভণ্ড অবতারের ভাষায় শুনতে চাই না: ‘ভয় কি বিবু, আমি আছি।’
কোনও ‘আমি’তে আমাদের বিশ্বাস নেই। আমাদের বরং বিশ্বাস আছে কাশ্মীরের বিষাদে।