প্রতীকী ছবি।
ভোট আসিতেছে। বঙ্গ-রাজনীতির ভাষ্যটিও ক্রমেই হিংস্রতর হইয়া উঠিতেছে। দুর্জনে বলিবে, যে খেলার যে নিয়ম— বঙ্গদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে, আর তাহাতে সন্ত্রাস হইবে না, তাহাও কি হয়? বস্তুত, বিজেপির সৌজন্যে এ বার ভিন্রাজ্যের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের স্লোগানও নিয়মিত ধ্বনিত হইতেছে বঙ্গের রাজপথে— ‘...গদ্দারোঁ কো’ ‘গোলি মারো’। বিজেপির মিছিলে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকরা ইটবৃষ্টি করিয়াছে বলিয়া অভিযোগ; পাল্টা অভিযোগ, বিজেপিও পাটকেল ফিরাইয়া দিয়াছে। সহিংস কর্মী-দলকে বাহবা দিয়াছেন নেতাগণ, প্রতিপক্ষকে হুমকি, অভিনেত্রীকে ধর্ষণের শাসানি। ঘটনা হইল, এ-কালে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনমাত্রেই রক্তাক্ত হইয়াছে। সন্ত্রস্ত রাজ্যবাসী ভাবিতেছেন, তবে কি ইহাই ভবিতব্য? কখনও কি হিংসা ব্যতিরেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কল্পনা করা যাইবে না? যে উত্তরপ্রদেশ বা বিহার একদা নির্বাচনী সন্ত্রাসের জন্য কুখ্যাত ছিল, সেখানেও তুলনায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হইতেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ক্রমেই হিংস্রতর, ভয়াবহতর হইয়া উঠিতেছে। কেন?
সন্ত্রাসের অভিযোগ শুনা যায় প্রধানত শাসকের বিরুদ্ধেই— একদা বামফ্রন্ট, অধুনা তৃণমূল কংগ্রেস। নির্বাচনী সন্ত্রাসের প্রশ্নে অবশ্যই শাসক দলের দিকে অঙ্গুলি উঠিবে, কিন্তু তাহা সন্ত্রাসদমনে প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে— একচেটিয়া সন্ত্রাস সৃষ্টি করিবার কারণে নহে। পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যান বলিবে, সন্ত্রাস ঘটাইতে বিরোধীরাও পিছপা নহে। যেখানে তাহারা শক্তিশালী, সেখানে বহু ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। অর্থাৎ, রাজ্যে সন্ত্রাসের ঘটনায় একটি ‘গণতান্ত্রিক বণ্টন’ ঘটিয়াছে। ‘সোনার পাথরবাটি’র ন্যায় শোনাইলেও কথাটি সত্য— এই রাজ্যে সন্ত্রাসে কোনও দলের একচেটিয়া দখল নাই। কেন, সেই কারণটি সন্ধান করিয়া কিছু অনুমান সম্ভব। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা লিখিয়াছিলেন, পার্টি বিনা (পশ্চিমবঙ্গের) গ্রামজীবন কল্পনাও করা যায় না। এই রাজ্যের সমাজ রাজনীতির অক্ষে বিভক্ত, ফলে, পরিচিতির মূল উপাদানও রাজনৈতিক আনুগত্য। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্য নিচু স্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাইয়াছে— সব দলের হাতেই ক্ষমতা, অর্থ এবং সেই সূত্রে বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র যথেষ্ট। সোনায় সোহাগা হইয়াছে সীমান্ত বরাবর বহু যত্নে লালিত একাধিক দুর্নীতিচক্র। সেই সূত্রে গ্রামীণ রাজনীতিতে কাঁচা টাকার খেলা চির-চলমান। প্রশ্ন উঠিবে, রাজ্যে যে সন্ত্রাস চলে, এই কাঁচা টাকাই কি একাধারে তাহার চালিকাশক্তি ও লক্ষ্য নহে— টাকা আছে বলিয়াই লড়াইয়ের ক্ষমতা আছে, এবং টাকার দখল ধরিয়া রাখিতেই এই লড়াই অবশ্যম্ভাবী? পশ্চিমবঙ্গে সমাজ যে হেতু রাজনীতির দ্বারাই বিভক্ত ও চিহ্নিত, সেই কারণেই কি এই টাকার লড়াইও শেষ অবধি রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হয়?
প্রশ্ন আছে, থাকিবেও। কিন্তু, তাহাতে প্রশাসনের দায় লাঘব হয় না। তাহাদের কর্তব্য, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভেদরেখাটিকে অনপনেয় করিয়া তোলা। হিংসার ঘটনা ঘটিলে রাজনৈতিক রং বিচার না করিয়াই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। হিংসা ও দলতন্ত্র, উভয়েই রাজ্যের অস্থিমজ্জায় প্রোথিত, ফলে কাজটি সহজ নহে। কিন্তু, সেই কাজটি করা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সুলভ হইবে না। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলি বাঘের পিঠে সওয়ার— দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি না-ও চাহে, তবুও কাঁচা টাকার স্রোত, ও তজ্জনিত হিংসা হইতে দলের নিচু স্তরের কর্মী-সমর্থকদের বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। রাজ্যের অর্থনীতিতে এখন রাজনীতিই সর্বাধিক কর্মসংস্থান করিয়া থাকে। সেই জায়গায় ঘা দিবে, নেতৃত্বের তেমন জোর কোথায়?