রাজনীতির চাপে জলের আকাল

বৃষ্টির জল ভূগর্ভে নামলেই সেই আর্সেনিক, ফ্লুয়োরাইড মিশে যাচ্ছে পানীয় জলের সঙ্গে। বাড়ছে আর্সেনিক ও ফ্লুয়োরাইড দূষণের শঙ্কা।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share:

জল সঙ্কট।

সে  দিন জল বাঁচাতে মুখ্যমন্ত্রী মিছিল করলেন শহরে। গ্রামে গ্রামে পুকুর কাটার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভূগর্ভের জলস্তর নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এগুলো কাজে আসবে কি? যতই পুকুর কাটা হোক, কুয়ো খঁুড়া হোক, মাটির তলায় পর্যাপ্ত জল না থাকলে পুকুর কিংবা কুয়ো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। কোথাও পুকুর বাঁচাতে পাম্প চালিয়ে ভূগর্ভ থেকে জল তুলে পুকুরে পাঠানো হচ্ছে। তাতে ভূগর্ভস্থ জলের ভারসাম্য ঠিক থাকছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনাবৃষ্টি। বর্ষা যত পিছিয়ে যাচ্ছে ততই নামছে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর। এতে শুধু জলের হাহাকারই তৈরি হচ্ছে না, ভূগর্ভে থাকা যৌগ আর্সেনিক ও যৌগ ফ্লুয়োরাইড মুক্ত হয়ে পড়ছে। বৃষ্টির জল ভূগর্ভে নামলেই সেই আর্সেনিক, ফ্লুয়োরাইড মিশে যাচ্ছে পানীয় জলের সঙ্গে। বাড়ছে আর্সেনিক ও ফ্লুয়োরাইড দূষণের শঙ্কা।

Advertisement

পরিবেশ বাঁচানোর থেকে রাজনীতি অগ্রাধিকার পাওয়ায় তার মূল্য দিতে হচ্ছে কৃষক তথা সাধারণ মানুষকে। কী ভাবে? বামফ্রন্ট আমলে ভূগর্ভের জল তোলা নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। তাতে বলা হয় ৫ অশ্বশক্তির ক্ষমতা বা তার বেশি ক্ষমতার পাম্প চালাতে গেলে ও কুয়ো খনন করতে গেলে জলসম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন দফতরের অনুমতি নিতে হবে। পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে অনুমতি চাই বিদ্যুৎ পরিবহণ সংস্থার কাছ থেকে। বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার জন্য খুঁটি, তার, ট্রান্সফর্মার বসানোর খরচও দিতে হবে আবেদনকারীকে। দিতে হবে বিদ্যুতের দামও।

তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসেই ওই আইন সংশোধন করে। বলা হয়, রাজ্যের ৩৭টি এমন ব্লক যাদের ভূগর্ভস্থ জলস্তর আংশিক বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে, সেগুলি ছাড়া অন্য সব ব্লকের কৃষকেরা ঢালাও ভাবে অগভীর নলকূপ ব্যবহার করে মাটির নীচ থেকে জল তুলতে পারবেন। পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য রাজ্য বিদ্যুৎ পরিবহণ সংস্থার অনুমোদন লাগবে না। ট্রান্সফর্মার, তারের খরচও দিতে হবে না কৃষককে। বিদ্যুৎ ব্যবহারও সুলভ হয়।

Advertisement

আইন শিথিল হয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর সংরক্ষণের বদলে তা খরচ হতে শুরু করে ঢালাও ভাবে। ২০০৫ সালের আইনটি যাঁদের পরামর্শে তৈরি হয়েছিল, তাঁদের এক জলবিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘‘উদ্দেশ্য ছিল ভূগর্ভের জল তোলা অনেকটা কমিয়ে আনা। অনেকে এই আইনকে কৃষকবিরোধী আখ্যা দিলেও, মনে হয়েছিল মানুষ যখন নিজেরা সচেতন হচ্ছেন না তখন এটাই একমাত্র দাওয়াই।’’ তাঁদের সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল, তা এখন স্পষ্ট— মন্তব্য করেন ওই জলবিজ্ঞানী। ওই জলবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ, এখন জুন-জুলাই মাসে একেবারেই বৃষ্টি না হওয়ায় মাটির নীচের জল এতটাই নেমে যাচ্ছে যে পাম্প চালিয়েও জল মিলছে না। ধানচারা পুঁতবেন বলে জমি তৈরি করে আছেন কৃষকরা। মাটির নীচে পর্যাপ্ত জল নেই, আকাশের জল নেই। বীজধান বীজতলাতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটির তলার জল-সংরক্ষণ কত জরুরি, বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি।

রাজ্য আর্সেনিক ও ফ্লুয়োরাইড টাস্কফোর্সের সদস্যদের দাবি, ঢালাও পাম্প বসানোর অনুমতি দেওয়াটা কেন্দ্র ও রাজ্যের সংশ্লিষ্ট আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। এতে খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিকের ছোঁয়া লেগেছে। শুধু আর্সেনিক নয়, জলস্তর যত নামছে ততই বাড়ছে ফ্লুয়োরাইড ও লোহা দূষণের মাত্রা।

কেন্দ্রীয় ভূজল নিগম সারা দেশে কোথায় ভূগর্ভের জলের স্তর কী অবস্থায় তা নিয়ে সমীক্ষা করে দেখেছে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর গত ১০ বছরে ২০.১৯ মিটার হ্রাস পেয়েছে। বর্ধমানে ১১.৪৮ মিটার, হুগলিতে ৯.২৫ মিটার, পূর্ব মেদিনীপুরে ১০.৭৫ মিটার, হাওড়ায় ৯.৫৫ মিটার ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমেছে। মুর্শিদাবাদে গত ১০ বছরে ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস পেয়েছে ৮.৫৩ মিটার, বীরভূমে ৭.২৭ মিটার, দক্ষিণ দিনাজপুরে ৪.২০ মিটার। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তর দিনাজপুরেও বিভিন্ন জায়গাতে ভূগর্ভস্থ জলস্তর হ্রাস পেয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলস্তর মোটামুটি বৃদ্ধি পেয়েছে বাঁকুড়া, দার্জিলিং, নদিয়া এবং পুরুলিয়া জেলায়। নিগমের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ঠিকঠাক বৃষ্টি হলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় জলস্তর নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

২০১১ সালে রাজ্য জল সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন দফতরের এক কর্তা এ সব আশঙ্কাকে আমল না দিয়ে বলেছিলেন, ভূগর্ভের জল সংরক্ষণের নামে কৃষকদের সেচের জল তুলতে দেওয়া না-হলেও সেই জল রাজ্যের মাটির নীচে আবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তা ভূগর্ভ দিয়েই অন্যত্র বয়ে যাবে। অন্য জায়গার কৃষকরা তা তুলে নিয়ে বাড়তি শস্য ফলাবেন। এ রাজ্যের চাষিরা জলের অভাবে মার খাবেন। কিন্তু গত আট বছর ধরে লাগামহীন ভাবে মাটির জল তুলে নেওয়ায় ও অনাবৃষ্টির থাবায় মাটির নীচের ভারসাম্য যে ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা এখন বুঝতে পারছেন ২০১১ সালে আইন সংশোধনের উদ্যোক্তারা।

ভূগর্ভের জল বাঁচাতে নতুন আইন তৈরি করা দরকার। তাতে কৃষকদের ঢালাও ভাবে ভূগর্ভের জল ব্যবহারের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ২০২১ সালের আগে এমন ঝুঁকি কি রাজ্য সরকার নেবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement