ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোনও বয়কট আন্দোলন হয়নি, যেখানে পাড়ায় বা রাস্তায় পিকেটিং করার দরকার পড়েনি। বঙ্গভঙ্গ থেকে খাদ্য আন্দোলন পর্যন্ত বঙ্গভূমে এমন কোনও বন্ধ, সত্যাগ্রহ, আইন-অমান্য কিচ্ছু করা হয়নি, যা কোনও সক্রিয় উদ্যোগ ছাড়া স্রেফ মনের ইচ্ছে দিয়ে সফল করে দেওয়া গিয়েছে। সবাই জানে, যতই জনসমর্থন থাক, পিকেটিং না করলে ধর্মঘট ব্যর্থ হবেই। জনতা যতই সহমর্মী হোক, গেট না আটকালে সুড়সুড় করে কাজে চলে যাবেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অবধি বঙ্গভঙ্গ আর স্বদেশি আন্দোলন সফল করতে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গাইতে গাইতে রাস্তায় শোভাযাত্রা করেছিলেন। তখন তাঁর দাড়ি ছিল চে গেভারার মতো।
আন্দোলনের এই যে লম্বা ঐতিহ্য, তার এক ও একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হল এই মুহূর্তে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন। বিশ্বে প্রথম বার স্রেফ বিধানসভায় মাইক ফুঁকেই এঁরা কর্ম খতম করে দেবেন ভেবেছেন। কর্মটা আসলে কী, সে বোঝাও অবশ্য ভারী শক্ত। অসম চুক্তি, যার ফলে এই এনআরসি নামক আপদের শুরু, তখন এঁরা কেউ তার বিরোধিতা করেননি। তার পরও গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। আত্মহত্যার মিছিল হয়েছে, লোকে ডিটেনশন ক্যাম্পের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে রাজ্যে-রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে। দেশব্যাপী এনআরসি এবং এনপিআর-এর কাজ শুরু হতে চলেছে। এবং সবার উপরে অনুপ্রবেশ সত্য— বেঙ্গালুরু থেকে বাঙালি ধরে বাংলাদেশে চালান করারও সুবন্দোবস্তও সমাপ্ত। আর জবাবে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? কী করে নথিপত্র জমা দিতে হবে, তার কোচিং ক্যাম্প খুলছে। আর বলছে, ভয়ের কিছু নেই। কেন নেই? না, বিধানসভায় তো আমরা প্রস্তাব এনেছি। এই এনআরসি খুব খারাপ।
তা এনআরসি খুব খারাপ সে আর নতুন কথা কী। কিন্তু তাকে এই ভাবে আটকানো হবে কী করে, বোঝা শিবেরও অসাধ্য। ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিতকরণ শহরে-শহরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ভোটার লিস্টে ‘সন্দেহভাজন’ চিহ্নিত করাও শীঘ্রই হয়ে যাবে। ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো তো চলছেই। এর পর সন্দেহভাজনরা নির্ঘাত ডিটেনশন ক্যাম্পেও চলে যাবে। নেতারা তখনও বিধানসভায় মাইক-ফুঁকে আর একটা প্রস্তাব এনে কর্ম সমাধা করবেন? খেল খতম পয়সা হজম?
কোনও বয়কট আন্দোলন, যে কোনও প্রতিরোধ আন্দোলন নিষ্ক্রিয় ভাবে হয় না। লবণ সত্যাগ্রহে গাঁধী নিজে আইন ভেঙেছিলেন, সামনে দাঁড়িয়ে। প্রতিরোধ বা বয়কট অন্য ভাবে হয় না। পাড়ায়-পাড়ায় জনমত সংগঠিত না করে প্রক্রিয়াটাকেই না আটকালে এনআরসি বা এনপিআর কোনও দিনই আটকানো যাবে না। পাড়ায় এক জন নিজের নথিপত্র দিলে দ্বিতীয় জনও দেবে, আর কে বাদ পড়তে চায়। সুসংবদ্ধ ভাবে পুরোটা বয়কট না করতে পারলে কিছুই হওয়া সম্ভব নয়। সেটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই, স্রেফ বুলি নয়।
এটা রাজনৈতিক দলগুলো হয় সত্যিই বোঝে না, বুঝছে না, কিংবা আসলে এরা আদৌ এনআরসি-বিরোধী নয়। বিরোধিতাটা স্রেফ মৌখিক, স্রেফ চোখে ধুলো দেওয়ার অপপ্রয়াস। কারণ, বিষয়টা আসলে জলবৎ তরলং। না বুঝে থাকা খুবই কঠিন, যে এই বিদেশি হটাও, শেষ বিচারে বাঙালিদের শায়েস্তা করার এক রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। কোনও বিহারি, কোনও তামিল, কোনও মরাঠি কাগজপত্র না দেখাতে পারলে কেউ তাকে বিদেশি বলবে, এ সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু কোনও বাঙালির কাগজপত্র না থাকা মানেই সে সম্ভাব্য বিদেশি।
এও বোঝা একেবারেই কঠিন না, এই অনুপ্রবেশ-বিরোধিতার নাম দিয়ে যা চলছে, তা আসলে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক। পাশাপাশি দুটো দেশ থাকলে তাদের মধ্যে কিছু যাতায়াত হবেই, যেমন হয় ভারত ও নেপালের মধ্যে। কিন্তু নেপালি ‘অনুপ্রবেশকারী’ নিয়ে কোনও হইচই নেই, পুরোটাই কেন্দ্রীভূত বাংলাদেশিদের নিয়ে। যেন অনন্তকাল দুই বাংলার মধ্যে থেকে যাবে বিধিদত্ত কাঁটাতার। সীমানা টপকালেই বলা হবে ‘ওই দেখ অনুপ্রবেশকারী’। এটা সংগঠিত সুসংবদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কিচ্ছু না। কাঁটাতারহীন সীমান্ত, এবং অনুপ্রবেশ নামক ধারণাটাকেই ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া, এ ছাড়া বঙ্গজাতিকে বাঁচানো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকতাকে রোখার দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। দুই বাংলার মাঝে সীমান্ত থাকলেই কাঁটাতার থাকবে, কাঁটাতার থাকলেই অনুপ্রবেশ, আর অনুপ্রবেশ থাকলেই ডিটেনশন ক্যাম্প। নেপালের মতো খুলে দেওয়া হোক বাংলাদেশ সীমান্ত, দুই বাংলার মানুষ আবার যাতায়াত করুক অবাধে, দেশভাগের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক রাষ্ট্র, এই হতে পারে একমাত্র আওয়াজ।
বঙ্গদেশের নেতারা অবশ্য এ পথের ধারেকাছেও নেই। তাঁরা ভাঙাভাঙিটা ভালই পারেন, কিন্তু অবাধ সীমান্ত? এঁদের বুদ্ধিতে দুনিয়া চললে ইউরোপে এখনও ফ্রান্স আর জার্মানি অস্ত্র-প্রতিযোগিতা করেই চলত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনও কালেই দিনের মুখ দেখত না। সমস্যাটা কী, আর তার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী, এই নিয়ে এ জাতীয় অভ্রংলিহ অজ্ঞতা এবং তার বুক-ঠুকে প্রদর্শন দুনিয়ায় বিরল।
ইতিহাসবিদ জয়া চট্টোপাধ্যায়ের বিবরণ যদি সত্য মানতে হয়, তবে নেতারা দেশভাগের সময়ও এই জাতীয় কাজ করে দেখিয়েছেন। তাঁদের নাকি ধারণা ছিল, দেশভাগ হবে এবং যেখানকার লোক সেখানেই অবিকল থেকে যাবে। উদ্বাস্তু-টুদ্বাস্তু হতে পারে, এটাই কারও মাথায় ছিল না। নির্বুদ্ধিতা বা সুবিধাবাদ যা-ই হোক, তার এ-হেন ফলিত প্রয়োগ দেখিয়েই তাঁরা কেউ বাংলার রূপকার, কেউ হিন্দুধর্মের মসিহা আখ্যা পেয়ে গিয়েছেন। এ বারের নির্বুদ্ধিতা তাকে টপকাতে পারে কি না, সে বিষয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও জারি আছে।