উত্তরণের পথ

ভারত নামক দেশটিতে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ শেষ হইয়াছে তেমনই এক বিপন্ন মুহূর্তে। বিপদ তাহার উদার, বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সত্তাটির।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

পুরাতন ভারত যাহাতে টুকরো টুকরো হইয়া অকালমৃত না হয়, তাহা দেখিতে হইবে।— এই বাক্যে সমাপ্ত হইয়াছিল বর্ষশেষের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। বর্ষশেষ এবং বর্ষারম্ভ এক অর্থে ক্যালেন্ডারের হিসাবমাত্র। কিন্তু তাহাকে একমাত্র অর্থ বলিলে মানুষের সৃষ্টি-সম্ভাবনার অমর্যাদা হয়। পুরাতন এবং নূতন বছরের সন্ধিক্ষণে দেশে দেশে অগণিত মানুষ নূতন করিয়া বাঁচিবার স্বপ্ন দেখেন, প্রতিজ্ঞা করেন, পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। তাহার অনেকখানি নিশ্চয়ই লোকাচার, কিন্তু সেই আচারের বাহিরেও, বস্তুত তাহার মধ্যেও, চেতনায় এবং অবচেতনে, নিহিত থাকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে অতিক্রম করিবার আকাঙ্ক্ষা, জীর্ণ পুরাতনকে কালস্রোতে ভাসাইয়া নবজীবনের গান গাহিবার আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের কোনও কোনও মুহূর্তে সেই আকাঙ্ক্ষা হইয়া উঠিতে পারে বিষম বিপদ সামলাইয়া বাঁচিবার শর্ত। ভারত নামক দেশটিতে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ শেষ হইয়াছে তেমনই এক বিপন্ন মুহূর্তে। বিপদ তাহার উদার, বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সত্তাটির। গণতান্ত্রিক ভারত সেই বিপদের মোকাবিলায় সফল হইবে, না আত্মসমর্পণ করিবে? বর্ষশেষের ওই বাক্যটি যে দায়িত্ব নববর্ষের হাতে তুলিয়া দিয়া গিয়াছে, সেই দায়িত্বে অবহেলা করিলে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের শেষে হয়তো আর ‘দেখিতে হইবে’ বলিবার সুযোগ থাকিবে না।

Advertisement

কেবল মোকাবিলার দায়িত্ব নহে, তাহার পথের সন্ধানও জানাইয়া গিয়াছে সদ্য-সমাপ্ত বছরটি। এক কথায় বলিলে, তাহা জনজাগরণের পথ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে দেশের বহু অঞ্চলে সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণসমাজ সমবেত এবং সরব হইলে জনপরিসরের চেহারা এবং চরিত্র কী ভাবে বদলাইয়া যাইতে পারে, ভারত তাহা নূতন করিয়া দেখিয়াছে। বুঝিয়াছে, ‘নিরন্তর সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল্য’— ছাত্রপাঠ্য বইয়ের পাতায় লিখিত এই বাণীর সার্থকতা সাহসী প্রতিস্পর্ধার সংগ্রামী অনুশীলনেই। আশার কথা, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সচেতন ও সংগঠিত গোষ্ঠী উত্তরোত্তর সরব এবং সচল হইতেছে, বিভিন্ন পরিসরে বিভিন্ন ভাবে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতেছে। তুলনায় রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশের ভূমিকা এখনও নৈরাশ্যজনক। সনাতন ভারতের হৃদয়পুর বলিয়া পরিচিত রাজ্যগুলিতে বিরোধী রাজনীতির শিবিরে এখনও জড়তা, দ্বিধা। কংগ্রেস নামক প্রাচীন দলটির জরা ও ব্যাধির লক্ষণ ভয়াবহ রকম প্রকট, সমাজবাদী পার্টি বা বহুজন সমাজ পার্টির মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলিও তথৈব। নাগরিক সমাজ সেই শাসকের মুখের উপর প্রতিবাদ জানাইতে অগ্রবর্তী, অথচ বিরোধী রাজনীতির নায়কেরা ভীত, সঙ্কুচিত, অথবা ক্ষুদ্র রাজনীতির হিসাবে মগ্ন!

এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী ঐক্যের আহ্বান জানান, তখন সেই আহ্বানের পিছনে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁহার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকিতেই পারে। কিন্তু, সূর্যকান্ত মিশ্ররাও মনে মনে জানেন, সেই যুক্তি দেখাইয়া তাঁহার বক্তব্যের গুরুত্ব অস্বীকার করিলে ভুল হইবে, ঐতিহাসিক ভুল। বিরোধী ঐক্য এখন কেবল জরুরি নহে, অপরিহার্য। তাহার জন্য এখনই একই মঞ্চে সমস্ত বিরোধী দলকে সমবেত হইয়া এক সুরে একই কথা বলিতে হইবে, এমন নহে। গত এক বা দেড় বছরে সঙ্ঘ পরিবারের অশ্বমেধের ঘোড়া রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বিভিন্ন বিজেপি-বিরোধী দল তথা শক্তির নিকট ক্রমাগত প্রতিহত হইয়াছে। ইহা এককেন্দ্রিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সফল প্রতিস্পর্ধা। নবজাগ্রত নাগরিক সমাজের সবল ভিত্তির উপরে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতির অনুশীলনের মধ্য দিয়াই হিন্দুত্ববাদী চিন্তা ও তাহার আশ্রিত রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলা সম্ভব। বস্তুত, তাহাই ভারতকে টুকরো টুকরো হইবার এই বিপদ হইতে রক্ষা করিবার একমাত্র পথ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement