ছবি: সংগৃহীত
কৃষ্ণনগরের হেড পোস্ট অফিস মোড়, নিত্য পথচারীরা থমকে দাঁড়াল। এ কী! কিছু মানুষ অ্যাপ্রন, টুপি পরিধান করে, সঙ্গে কিছু ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে পরস্পরের হাত ধরে প্রধান রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এরকম দৃশ্য তো সচরাচর দেখা যায় না, সে কারণে অবাক হতেই হল।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বত্র এনআরসি, সিএএ এবং এনপিআর বিরোধী মিটিং-মিছিল, পথসভা, ধর্না হতে দেখা যাচ্ছে। সরকারি নীতিতে মানুষের প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। এ হেন সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কিছুটা অপ্রত্যাশিত হলেও পরিবেশ বাঁচানোর দাবি নিয়ে এক দল মানুষ পথে নামল। রচিত হল মানববন্ধন, আর যার সাক্ষী থাকল কৃষ্ণনগর।
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার জেলার সদর শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এই মানববন্ধন তৈরি হয়েছিল। পরিবেশ বাঁচানোর দাবি নিয়ে ‘সেভ জলঙ্গি নদী সমাজ’-এর ডাকে কিছু পরিবেশপ্রেমী মানুষ পথে নামলেন। তাঁরা এক মানববন্ধন গড়ে তুললেন, যা কৃষ্ণনগরের পুরসভা মোড় থেকে হেড পোস্ট অফিস মোড় অতিক্রম করে গেল। কথায় আছে ‘রমতা সাধু অউর বহতা নদী’ অর্থাৎ সাধুর স্বভাব হল পরিব্রাজন আর নদীর কাজ হল বয়ে যাওয়া। কিন্তু বর্তমান যুগে সেই নদীকে আপন গতিতে বয়ে যেতে আমরা দিচ্ছি না। নদিয়া জেলার অনেক নদী কালের নিরিখে তাদের গতিপথ হারিয়েছে। অলকানন্দা নদীর তীরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, সেই অলকানন্দা নদীর অস্তিত্ব আজ আর নেই। কিন্তু জায়গাটির নাম ‘গঙ্গাবাস’ আজও রয়ে গিয়েছে। কলিঙ্গ নদীও লুপ্তপ্রায়, কেবল বর্ষার সময় নদীখাতটি বোঝা যায়। মাথাভাঙা, চূর্ণী নদীও দূষণে ভর্তি। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে স্থান পাওয়া অঞ্জনা নদীর মৃত্যু অনেকেই চাক্ষুষ করেছেন। এখন অঞ্জনাকে দেখতে হলে দোগাছি, বাদকুল্লায় যেতে হবে। তার কিছু অবশিষ্টাংশ সেখানে মেলে। কিন্তু কৃষ্ণনগরে সে অস্তিত্ব হারিয়েছে।
নদিয়া জেলার অন্যতম নদী জলঙ্গিরও আজ করুণ দশা। বিগত ৫০ বছরের মধ্যেই জলঙ্গি নদীর গতিপথ বেশ কিছুটা কমেছে। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? সভ্যতা দিনে দিনে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু নদী তার শরীর হারিয়েছে। মানব সমাজের উন্নতি যত বেড়েছে, প্রকৃতির উপর অত্যাচারও বেড়েছে। আবার কয়েক দশকে অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সেটিও অন্যতম কারণ। আমরা পরিবেশ বাঁচাতে পারছি না, ভীষণ ভাবে এর জন্য দায়ী। তবে নিজেদের পরিবেশের যথাযথ দেখভাল করতে না পারার জন্য সরকারকেও কি দায়ী করা হবে না? ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন বলেও যে কিছু হয়, সরকার কি সেটা জানে না?
দীর্ঘ দিন অবহেলার শিকার হয়ে জলঙ্গি ধীরে ধীরে তার নাব্যতা হারিয়েছে। কোনও এক সময় নদী পাড়ের লেখক ‘বহে চলে জলঙ্গি’ লিখে তৃপ্ত হয়েছিলেন। সেই নদী আজ আর নেই। আমাদের সেই লেখা পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। খুব বেশি দিন আগেকার কথা নয়, জলঙ্গিতে শুশুক খেলতে দেখা। নদীর চরিত্র পরিবর্তিত হলে তারাও জলঙ্গির ভিটেমাটি ত্যাগ করে। দূষণের জেরে নদীর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। নদিয়া-রাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে এই জলঙ্গি নদীকেই ‘গাঙ্গিনী’ (ছোট গঙ্গা) বলে উল্লেখ করেছিলেন, যা এখন সুদূর অতীত।
ইতিপূর্বে গঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন হতে দেখা গিয়েছে। নদিয়া জেলাতেও বিভিন্ন সময়ে নদীকে নিয়ে মানুষের যে আবেগ রয়েছে, তা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। নদিয়া জেলা যেমন মাথাভাঙা-চূর্ণী বাঁচাও আন্দোলন দেখেছে, তেমনই অঞ্জনা ও জলঙ্গি বাঁচাও আন্দোলনে নদিয়ার মানুষেরা শামিল হয়েছে। অঞ্জনাকে কিন্তু বাঁচানো যায়নি। তবে তার পরেও জলঙ্গি, মাথাভাঙ্গা বা চূর্ণী কাউকেই দূষণমুক্ত করা যায়নি।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রকে অনেক সময় বধির সেজে থাকতে হয়। তাই সেই বধিরত্ব কাটাতে হলে আমাদের আরও জোর গলায় প্রতিবাদ করতে হবে। আঘাত নেমে আসতে পারে, কিন্তু পিছু হটলে চলবে না। আমরণ অনশন সত্যাগ্রহে বসা হরিদ্বারের মাতৃসদন আশ্রমের ২৩ বছরের ব্রহ্মচারিণী পদ্মাবতীর উপর যেমন আঘাত নেমে এসেছিল, আমাদের রাজ্যেও শান্তিপুরের এবং উত্তরবঙ্গের পরিবেশ কর্মীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু থমকে গেলে চলবে না। এই মানববন্ধন যেন সেই সকল আক্রমণেরই প্রতিবাদ স্বরূপ।
বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এই মানববন্ধন কর্মসূচিতে বেশ কিছু সাধারণ মানুষকেও অংশ নিতে দেখা যায়, যা কিছুটা ইতিবাচক বার্তা দেয়।
বর্তমান বিশ্বের একটি অন্যতম সমস্যা হল পরিবেশ দূষণ। তাই সকলকে একযোগে এই পরিবেশকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের নদিয়া জেলায় বেশ কিছু সংগঠন পরিবেশকে বাঁচাতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছেন। পুরাতন সংগঠনগুলি তো রয়েইছে, তার সঙ্গে নতুন কিছু সংগঠনও গড়ে উঠেছে। শান্তিপুরের সায়েন্স ক্লাব, রানাঘাটের নেচার ফার্স্ট, মাথাভাঙা চূর্ণী নদী বাঁচাও কমিটি, চাপড়া মানব কল্যাণ সমিতি, তেহট্টর জলঙ্গি নদী বাঁচাও কমিটি-র মতো সংগঠন বেশ কয়েক বছর ধরে জেলার পরিবেশ সংক্রান্ত সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্য তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণ, জল দূষণ, ভূমিক্ষয়, বায়ু দূষণ থেকে নদিয়া জেলাকে মুক্ত করতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রশ্ন হল সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন হয়েছে? আমরা নিজেরা যদি নিজেদের এলাকার পরিবেশের প্রতি একটু যত্নবান হই, তবেই এই আন্দোলন পুরোপুরি সফল হবে। পরিবেশ বাঁচাতে এমন মানববন্ধন গড়ে তুলতে হবে, যা হবে অটুট, বিশ্বাসযোগ্য।
শিক্ষক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়