গ্রাম গোয়ালমাল। ছবি সৌজন্যে লেখক
কাছেপিঠে অন্য কোনও গ্রাম নেই। চারদিকে সবুজ মাঠঘেরা গ্রামটিকে দূর থেকে তাই একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হয়। পশ্চিমে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার ফাঁকা মাঠ পেরোলে মুরারইয়ে পৌঁছনো যায়। উত্তরের পাইকর কিংবা দক্ষিণে রুদ্রনগর, স্বর্গডাঙা গ্রামগুলিও কমবেশি তিন-চার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। বাসপথে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে কাছের গ্রাম বোনহা পৌঁছতেও মেঠো পথ ধরে দু-আড়াই কিলোমিটার যেতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত এই বিচ্ছিন্নতার জন্য শুধু নয়, গ্রামটির অনন্যতার অন্য একটি দিকও আছে। সেটি হল, গ্রামের অধিবাসীদের মুখের ভাষা।
চারপাশের বাংলাভাষী মানুষজনের মাঝে বহুকাল বসবাস করেও মুরারই থানার এই গোয়ালমাল গ্রামের একটা বড়ো অংশের মানুষ আজও কথা বলে ‘খোট্টা’ ভাষায়। গ্রামের মুসলমান ধর্মাবলম্বী হাজার তিনেক মানুষের সকলেরই কথ্যভাষা এটি। তবে ‘খোট্টা’ কেবল নিজেদের পারস্পরিক ভাব বিনিময়েই তারা ব্যবহার করে আসছে বংশ পরম্পরায়। বাইরের অন্যান্যদের সঙ্গে, এমনকি গ্রামে পাশাপাশি বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের কমবেশি আড়াই হাজার মানুষের সঙ্গেও কথাবার্তা চলে বিশুদ্ধ বাংলাতে। গ্রামের এই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা গ্রামের স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করে যথারীতি বাংলাতে, কিন্তু স্কুলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে ‘খোট্টা’য়। শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে ষোলআনা বাঙালি হয়েও এরা জীবনচর্চার ক্ষেত্র থেকে পূর্বপুরুষের মুখের ভাষাকে আজও বিসর্জন দেয়নি। গোয়ালমালের মুসলমান গ্রামবাসীদের সকলেই তাই দ্বিভাষী হিসাবেই আমৃত্যু জীবনযাপন করে আসছে প্রজন্ম পরম্পরায়। কয়েক শতাব্দির এই ভাষাগত বিশিষ্টতা নিয়ে এলাকায় নিজের পরিচিতিকেও উজ্জ্বল রেখেছে গোয়ালমাল।
যদিও কথ্যভাষা হিসাবে ‘খোট্টা’ বীরভূম জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গে অপরিচিত কোনও ভাষা নয়। ওড়িয়া ও বাংলার সংমিশ্রণজাত ‘কেরা’, মালদহের ‘চাঁই’, ওপার বাংলার ‘শ্রীপুরিয়া’ প্রভৃতির মতোই, বাংলা ও হিন্দি-উর্দুর মিশেলে সৃষ্ট ‘খোট্টা’ বাংলাভাষার একটি খণ্ড উপভাষা (Sub-dialect) হিসাবে ভাষাবিদদের কাছে স্বীকৃত। শেরশাহের বাংলা ও অঙ্গিকার বিমিশ্রণে বিশেষ জনগোষ্ঠীর কথ্যভাষা রূপে কালস্রোতে গড়ে উঠেছিল এটি। ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় অতীতের পূর্ব মাগধী ও বাংলার মিশ্রণে গড়ে ওঠা কথ্যভাষা বলেও অভিহিত হয়। যেহেতু এর লেখ্যরূপ নেই, তাই অঞ্চলভেদে এর ব্যবহারিক রূপের বৈচিত্র্য আগেও ছিল এবং এখনও আছে। পূর্ব ভারতে প্রধান যে দুটি রূপের নিরিখে খোট্টার বিভাজন করা হয়, তার একটি ‘দক্ষিণী খোট্টা’ ও অপরটি ‘উত্তরী খোট্টা’। দক্ষিণীর চল এ রাজ্যের বাইরে, বোকারো থেকে হাজারিবাগ অঞ্চলে আছে। এ রাজ্যে ‘উত্তরী খোট্টা’ই নানা আঞ্চলিক রূপে বিবর্তিত হয়ে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন সর্বপ্রথম ভারতীয় উপভাষা সম্পর্কে যে গবেষণামূলক অনুসন্ধান করেন, তাতেও ‘খোট্টা’-র বিষয়টি উঠে আসে। তাঁর 'Linguistic Survey Of India' তে এ সম্পর্কে আলোকপাত আছে। তিনি লেখেন--‘On the western boundary of this dialect (Eastern Magahi) there are various mixed dialects which are generally known as 'Khotta' or impure Bengali.It is often difficult to say whether these should be classed as a dialect of Bengali, or of the neighbouring Bihari.’
আমাদের রাজ্যে মালদহের ব্যাপক এবং মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকায়, যেমন সুতি, সমশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, জঙ্গিপুরের বিক্ষিপ্ত অংশে কথ্যভাষা হিসাবে খোট্টার প্রচলন বহু আগে থেকেই। সাবেক মেদিনীপুর জেলারও কোথাও কোথাও খোট্টাভাষী মানুষের বসবাস। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি সহ জেলার রাজনগর, খয়রাশোল, দুবরাজপুর থানার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে এখনও বহু মানুষ আছে, যারা ‘খোট্টা’ভাষী। যেহেতু পূর্বতন বিহার রাজ্য থেকে পূর্বপুরুষদের আগমনসূত্রেই বীরভূমে এই ভাষার প্রচলন, তাই বর্তমানের ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন উত্তর প্রান্তিক বীরভূমের বহু গ্রামাঞ্চলে বাংলার এই খণ্ড উপভাষাটির দেখা মেলে। রাজগ্রামের পূর্বতন গ্রামীণ বসতি সহ মূর্শিদাবাদের দিকে হাড়োয়া, ডাঁই, বংশবাটি, বহুতাল প্রভৃতি গ্রামাঞ্চলে খোট্টায় কথা বলা বহু পরিবারের বসবাস। রণপুর, হিয়াতনগর, কামারখুর, বর্ধনপাড়া, পঞ্চহাট, হিরোলা, বরোজ, রহমতপুর, বোধপুর, প্রভৃতি বিক্ষিপ্ত গ্রামের নামও এ তালিকায় আসে। কাহিনগর, মহুরাপুর, পানীশাইল, শালিশাণ্ডায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পরিবার ছি ল বা এখনও আছে, যাদের কথ্যভাষা ‘খোট্টা’।
কালের পরিবর্তনে এ-সব অঞ্চলে ভাষাটি ক্রমেই যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খাঁটি বাংলাভাষী পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলে পরিবারের ভাষাগত আবহের যেমন বদল ঘটছে, তেমনি বাংলায় লেখাপড়া ও বহুল সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষের সঙ্গে নিত্যকার জীবন যাপনের ফলে,নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা খোট্টা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাই হয়ে উঠেছে তাদের একমাত্র ভাষা। এজন্য পশ্চিমবঙ্গে ‘খোট্টা’-সহ একাধিক আঞ্চলিক উপভাষার অস্তিত্বের বিপন্নতা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের আক্ষেপ করতেও শোনা যায়।
কিন্তু, মাতৃভাষাকে বর্জন করার এই অনিবার্য স্রোতে গা ভাসায়নি মুরারইয়ের গোয়ালমাল। সেখানের মুসলমান অধিবাসীরা বাংলাভাষাকে আপন করেও আজও পরম মমতায় ‘খোট্টা’ ভাষাকে আঁকড়ে ধরে আছে। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে ঐতিহ্যসূত্রে পাওয়া মুখের ভাষাকে প্রজন্ম পরম্পরায় বয়ে নিয়ে চলেছে। গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব প্রজ্ঞাবান মানুষ হাজী সিদ্দিক খান, আইনের ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিন কিংবা অধ্যাপিকার তালিকায় নাম তোলা স্কুলশিক্ষিকা রজনী খাতুন, প্রবীণ-নবীন প্রজন্মের কেউই এর ব্যতিক্রম হয়ে ওঠেননি। এ গ্রামেরই আরেক মেয়ে বাংলায় এম ফিল করা শিক্ষিকা ফেরদোসী খাতুন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ভাষাতত্ত্বের পাঠ দিয়ে এসে বাড়িতে যখন ‘খোট্টা’-য় কথাবার্তা বলেন, তখন অন্য তাৎপর্য পেয়ে যায় তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত মাতৃভাষাপ্রীতি। পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে খাঁটি বাংলাভাষী হলেও নিজেদের মধ্যে ‘খোট্টা’-য় কথা বলাতেই প্রাণের পরিতৃপ্তি খুঁজে পান এঁরা।
এ ভাবে নিজেদের ভাষাগত বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখাটা আজও সম্ভব হল কী ভাবে! এ প্রসঙ্গে গ্রামসূত্রে জানা যায়, নবাব আলিবর্দির শাসনকালে বিহার প্রদেশ থেকে গোয়ালমাল গ্রামে এসে প্রথম বসবাস শুরু করেছিল তিন চারটি ‘খোট্টা’ভাষী পাঠান পরিবার। কালক্রমে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ওঠে পাঠানপাড়া, সেখপাড়া, মসজিদপাড়া, ইদগাহপাড়ার বসতি। এরা বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাইরের খোট্টাভাষী পরিবারকেই বরাবর বেছে নিয়েছে। জেলার ও জেলার বাইরের আহিরণ, সুজাপুর, কামারখুর, দফরপুর প্রভৃতি খোট্টাভাষী গ্রামের মেয়েরাই বিবাহসূত্রে পরিবারের বধূ হয়ে এসেছে। বৈবাহিক সম্পর্ককে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা ভাষার সংমিশ্রণের পথকেও রুদ্ধ করেছে। খান, পাঠান, মির্জা প্রভৃতি খোট্টা পদবির সঙ্গে, এ গ্রামে শেখ, মল্লিক প্রভৃতি কিছু বাঙালি মুসলমান পদবিরও দেখা মেলে। সে সব ক্ষেত্রে, তাঁদের পূর্বপুরুষদের কেউ ঘরজামাই সূত্রে এখানে এসেছিলেন বলে জানা যায়। পিতার পদবি সন্তানেরা গ্রহণ করলেও, কথ্যভাষার ক্ষেত্রে মায়ের মুখের ভাষাকেই পরবর্তী প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলেছে কাল থেকে কালান্তরে। এইভাবে ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে শুধু নয়, মুরারইয়ের গোয়ালমাল চারপাশের ভিন্ন ভাষাপ্রবাহের মাঝে জেগে আছে আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল এক ভাষাদ্বীপ হয়ে!
লেখক কয়থা হাইস্কুলের শিক্ষক, মতামত নিজস্ব